Monday, January 26, 2015

প্রথম বাঙ্গালি সেনা কর্মকর্তা এবং প্রথম বাঙ্গালি জেনারেল ইশফাকুল মাজীদ

Source LINK

 কিম্বদন্তির এক মহানায়কঃ ভুলে যাওয়া বাংগালী প্রথম জেনারেলে্র কথকথা ।


===============================================
আজকে যে মাহান ব্যক্তিটি সম্পর্কে লিখছি তিনি হচ্ছেন একাধারে প্রথম বাঙ্গালি সেনা কর্মকর্তা এবং প্রথম বাঙ্গালি জেনারেল ইশফাকুল মাজীদ। সেনাবাহিনী থেকে তিনি অবসর গ্রহনের আগ পর্যন্ত মেজর জেনারেল পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি একই সাথে ব্রিটিশ, ভারত ও পাকিস্তান এই তিনটি সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেন। তিনিই সর্বপ্রথম বাংগালী হিসেবে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন ১৯২২ সালে এবং দেশ বিভাগের পরে তিনি মেজর জেনারেল পদে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। উল্লেখ্য, তিনি জেনারেল আইয়ুব খানের ২ বছরের জ্যেষ্ঠ ছিলেন। তিনি ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহন করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তাকে যথাযথ মূল্যায়ন না করা এবং আইয়ুব খানের সাথে তার দ্বন্দের কারনে। জাতির এই বীর সন্তান আমাদের স্বাধীকার আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন। আজ লিখতে বসেছি, কোন সাধারন ব্যক্তিকে নিয়ে নয়। ইতিহাসের দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যাওয়া এক জেনারেলের ব্যাক্তিগত জীবনি নিয়ে আজকের এই লেখা। ইতিহাসের অনেক দায় আমরা মেটাতে পারিনি। জাতি আজ আর স্মরন করে না তার সেই বীরকে। তিনি আজ ইতিহাসের পাতা থেকে সুদূর পরাহত। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌছাতে পারেনি তার নাম। আমাদের এই প্রজন্ম তাকে চিনে না, কারন এই প্রজন্মকে এই বীরের সাথে পরিচয় করানো হয়নি। ইতিহাসের সেই দায়বোধ থেকেই আজকের এই লেখা। পাঠকদেরকে অনুরোধ রইল কষ্ট হলেও পুরো লেখাটি পড়তে। তাহলে বোধহয় এটাই হবে সেই জেনারেলের প্রতি আমাদের সর্বোচ্চ সম্মান।
পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভায়রা ভাই। জাতির এই বীর সন্তান ছিলেন অনেকটা নিজের মধ্যে আবদ্ধ, তিনি ছিলেন না নিজের কোন প্রচার প্রচারনায়। বড়ই নিভৃতে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে। স্বাধিনতার পর তিনি আর মাত্র ৫ টি বছর বেঁচেছিলেন। জাতির এই বীর সন্তান স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের কাছ থেকে সাহায্য সহযোগিতা বা অবসরকালীন ভাতা গ্রহন করেননি। তিনি তার জীবনের শেষ কয়টি দিন একাকী অতিবাহিত করেন ফতুল্লায় একখন্ড জমির উপর তৈরীকৃত তার নিজের বাসভবনে। জেনারেল মাজীদ সম্পর্কে খুব কমই তথ্য পাওয়া যায় বিভিন্ন রেকর্ড ঘেটে। নিচে তার ব্যাক্তিগত জীবনের কিছু তথ্য ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি সবাই আগ্রহ নিয়ে পড়বেন।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচিতিঃ
বাঙ্গালী সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে মেজর জেনারেল ইশফাকুল মাজীদ ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি ছিলেন সকল বাঙ্গালী সেনা কর্মকর্তাদের জ্যেষ্ঠতম। ইশফাকুল মাজীদ জন্ম ১৯০৩ সালের ১৭ই মার্চ আসামের জোরহাটে। তিনি তার স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন আসামের গৌহাটির কটন কলেজ থেকে। তারপরে তিনি ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্ট মিলিটারি কলেজ থেকে স্নাতক লাভ করার দূর্লভ সুযোগ লাভ করেন। তিনি ছিলেন বাঙ্গালি মুসলমানদের মধ্যে প্রথম যিনি স্যান্ডহার্স্ট মিলিটারি কলেজে অধ্যয়ন করার সুযোগ লাভ করেন। একই সাথে তিনি বাঙ্গালিদের মধ্যে প্রথম যিনি এই স্যান্ডহার্স্ট মিলিটারি কলেজ থেকে অধ্যয়ন শেষ করে সাফল্যের সাথে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদানের সুযোগ লাভ করেন। তিনি আফগানিস্তান ও বার্মায় দুটি যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন।
ইশফাকুল মাজিদের পিতার নাম হচ্ছে, আবদুল মাজীদ সি.আই.ই.। তার পিতা সেই সময় ভারতীয় বিচায় বিভাগে চাকরী করতেন এবং ১৯১৯ সালে তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে আসাম গভর্নরের নির্বাহী কাউন্সিলর হিসেবে নিযুক্ত হন। ইশফাকুল মাজীদের মাতা ছিলেন একজন গৃহিনী। তিন ভাই আর চার বোনের মধ্যে ইশফাকুল মাজীদ ছিলেন দ্বিতীয়।
ইশফাকুল মাজীদের বড় ভাই ইনামুল মাজীদ ১৯২২ সালে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হন। তার অপর ভাইও ছিলেন একজন সরকারী চাকরিজীবি। তার এই দুই ভাই সাতচল্লিশের দেশ ভাগের পর ভারতে থেকে যান। তার বোনদের মধ্যে একজনের নাম ছিল জোবায়দা আতাউর রহমান। তিনি সেইসময় ভারতের আসাম রাজ্যের বিধানসভার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময় ভারতবর্ষের অন্য কোন প্রাদেশিক বিধানসভায় কোন মহিলা প্রেসিডেন্ট ছিলো না। তার অপর দুই বোনের মধ্যে একজনের বিয়ে হয়েছিল নোয়াখলির কাফিলউদ্দিন চৌধুরীর সাথে আর অপরজনের বিয়ে হয়েছিল ঢাকার ডব্লিউ. এস. আহমেদের সাথে। তারা দুইজনই ছিলেন বনবিভাগের কর্মকর্তা। তার অপর বোনের বিয়ে হয়েছিল আর. রহমান নামের এক পুলিশ অফিসারের সাথে। তিনি ছিলেন আসাম পুলিশের প্রথম ভারতীয় ডি.আই.জি.।
ইশফাকুল মাজীদ বিয়ে করেছিলেন ১৯৩৫ সালে সেই সময়ের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব স্যার আবদুর রহিমের কণ্যা এ. আই. মাজীদকে। উল্লেখ্য স্যার আবদুর রহিমের অপর কণ্যাকে বিয়ে করেছিলেন হোসেন সোহরাওয়ার্দী। সেই হিসেবে তারা দুইজন ছিলেন ভায়রা-ভাই।
কিন্তু বিয়ের মাত্র ছয় বছরের মাথায় ১৯৪১ সালে মারা যান ইশফাকুল মাজীদের প্রিয়তমা স্ত্রী এ.আই. মাজীদ। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন, কিন্তু তার সেই সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তারপর তিনি তৃতীয় বিয়ে করেন মোঃ ইসমাঈল খানের কণ্যা মরিয়ম বেগমকে। এই দম্পতির কোন সন্তান ছিল না, যদিও পরবর্তিতে তারা একটি কণ্যা সন্তান দত্তক নেন এবং তার সেই কণ্যা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন।
কর্মজীবনঃ
সময়টি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগ। সেই সময়ে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কোন ভারতীয় কমিশন্ড অফিসার ছিল না। কিন্তু, ভারতীয় সাধারন সেনারা যেই যুদ্ধে ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের অধীনে সাফল্যের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহন করে এবং বিভিন্ন খন্ডযুদ্ধে জয় লাভ করে। সেই সাথে সেই সময়ে সেনাবাহিনীতে ব্যপক অফিসার সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। তাই, তখন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর শীর্ষকর্তারা যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যদের সাফল্য দেখে সন্তুষ্ট হয়ে এবং একইসাথে সেনাবাহিনীতে অফিসার সঙ্কট দূর করতে ভারতীয়দের সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
এই বিজ্ঞপ্তিটি সেই সময়ের খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়। যার একটি অনুলিপি নিন্মে দেওয়া হলঃ-
“The king’s commissions to Indians are to be issued in the near future. It was bound to come and stay after the glorious gallantry of the soldier-sons of the East displayed in the battlefield of the west. It was bound to come in order to enable the government to secure a better class of recruits for military service. Nine commissions are to be granted immediately to the nine worthies. It is the step in the right direction and His Majesty’s Government is to be congratulated on this.” -------[ The Hindu Patriot, 25 August,1917]
এই বিজ্ঞপ্তির পরে প্রথমবারেরমত দুইজন ভারতীয় ক্যাডেট ব্রিটেনের রয়াল মিলিটারি কলেজ, স্যান্ডহার্স্টে যোগদান করেন। সেই সময়ে সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য কোন প্রার্থীকে প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়ার পাওয়ার পরে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধায়নে প্রাদেশিক গভর্নরের কাছে চূড়ান্ত মনোনয়নের জন্য বাছাইপর্বে অংশগ্রহন করতে হয়। ১৯২১ সাল পর্যন্ত সর্বোমোট ১৫ জন বাঙ্গালী তরুণ চূড়ান্ত মনোনয়ন পর্বে অংশগ্রহন করতে সমর্থ হয়। কিন্তু, সেসময় স্যান্ডহার্স্ট মিলিটারি কলেজে পর্যাপ্ত কোটা না থাকার কারনে তাদের মধ্যে চৌদ্দজনই চূরান্ত পর্বে উত্তীর্ণ হতে পারননি। এই ১৫ জনের মধ্যে শুধুমাত্র লর্ড সিনহার সন্তান তরুন কুমার সিনহা চূড়ান্ত বাছাই পর্বে উত্তীর্ণ হয়ে রয়াল মিলিটারি একাডেমিতে যোগদান করতে সক্ষম হন। কিন্তু তরুণ পরবর্তীতে তার মিলিটারি কোর্স আর সমাপ্ত করেননি। তরুন কুমার সিনহার পরে ইশফাকুল মাজীদই হচ্ছে দ্বিতীয় বাঙ্গালী এবং প্রথম বাঙ্গালী মুসলিম যিনি স্যান্ডহার্স্ট রয়াল মিলিটারি কলেজ যোগদান করতে সক্ষম হন।
ইশফাকুল মাজীদ রয়াল মিলিটারি একাডেমি, স্যান্ডহার্স্ট এ অফিসার ক্যাডেত হিসেবে যোগদান করেন ২রা, ফেব্রুয়ারী ১৯২২ সালে। পুরো ব্রিটিশ শাসনামলে সমগ্র ভারতবর্ষ থেকে সর্বমোট তিনশত জন স্যান্ডহার্স্টে যাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন, তাদের মধ্যে ইশফাকুল মাজীদই হচ্ছেন একমাত্র মুসলিম বাঙ্গালি। তার পূর্বে মুর্শিদাবাদ থেকে ইস্কান্দার মীর্জা নামে একজন ক্যাডেট স্যান্ডহার্স্টে যেতে সক্ষম হন। ভারতীয়রা ১৯৩২ সালে দেরাদূনে মিলিটারি একাডেমি প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত এই স্যান্ডহার্স্ট থেকেই প্রশিক্ষন লাভ করতেন।
“London Gazelle” এর তথ্যমতে মিলিটারি একাডেমির প্রশিক্ষন শেষ করে তিনিসহ ১১৫ জন ক্যাডেট ২৯শে আগস্ট, ১৯২৪ সালে কমিশন লাভ করেন। সেই ব্যাচ থেকে ১৮ জন ক্যাডেটকে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নিয়োগ লাভ করেন। এই ১৮ জনের মধ্যে তিনিসহ মাত্র তিনজন ছিলেন ভারতীয়। তিনি মিলিটারি সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল অর্জন করে স্যান্ডহার্স্ট মিলিটারি কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হন। বিভিন্ন বিষয়ে তার ফলাফলের রেকর্ড নিন্মে তুলে ধরা হলোঃ
মিলিটারি এডমিনিস্ট্রেশন ৯১ মিলিটারি ল ৮৮ ট্যাকটিকস ১৬৩ ম্যাপ রিডিং ১৬৬ মাসকেট্রি ৮৬ ড্রিল ৩১ সর্বমোট ৬২৫
কমিশন লাভের পর ইশফাকুল মাজীদকে নিযুক্ত/সংযুক্ত করা হয় ২ নাম্বার ব্যাটালিয়নের লিনকনশায়ার রেজিমেন্টে তাকে লক্ষনৌ এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এক বছর পরে, তাকে ৪/১৯ হায়াদ্রাবাদ রেজিমেন্টে বদলি করা হয়। ইশফাকুল মাজীদ তার কর্মজীবনের সূচনালগ্নের বেশিরভাগ সময় এই ৪/১৯ হায়াদ্রাবাদ রেজিমেন্টে কাটান। ৪/১৯ হায়াদ্রাবাদ রেজিমেন্টের হয়ে চাকুরীসূত্রে তিনি ইরাক, আল্লহাবাদ, কোয়েটা, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশ ও শহর ভ্রমন করেন। মেজর থিমায়া (পরবর্তীতে ভারতের সেনাপ্রধান) এবং মেজর আজম খান (পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর) ইশফাকুল মাজীদের সাথে এই একই ইউনিটে দায়িত্ব পালন করেন। খন্ডকালীনভাবে বিভিন্ন সময় তিনি ১০/১৯ ও ১১/১৯ হায়াদ্রাবাদ রেজিমেন্টের হয়ে তিনি বারানাস ও দিমাপুরে দায়িত্ব পালন করেন। ইশফাকুল মাজীদ ১৯২৫ সালে ল্যাফটেন্যান্ট ও ১৯৩৩ সালে ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি লাভ করেন। পরবর্তীতে হায়াদ্রাবাদ রেজিমেন্টের নাম পরিবর্তন করে করা হয় কুমাঁও রেজিমেন্ট। সেই কুমাঁও রেজিমেন্ট এখনো পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীতে রয়েছে।
শুরু থেকেই ইশফাকুল মাজীদ আসাম রাইফেলসে বদলি হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তার এই বদলি হওয়া সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি উত্তর পশ্চিম ফ্রন্টিয়ার রিজিয়নের হয়ে আফগানিস্তান, মালায়া ও বার্মায় অনেকগুলো অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তিনি আগ্রার কুমাঁও রেজিমেন্টাল সেন্টারের কমান্ড্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেন। মেজর থিমায়া (পরবর্তীতে ভারতের সেনাপ্রধান) সেই রেজিমেন্টে তার সহকারী হিসেবে উপ অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
পরবর্তীতে তিনি আগ্রার কেন্দ্রীয় সেনাসদরে জেনারেল জিওফ্রে স্কুনের স্টাফ অফিসার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। সেখান থেকে তাকে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড হেডকোয়ার্টারে (কোলকাতায় অবস্থিত) সহকারি এডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্বল্পমেয়াদে নিযুক্ত অনেক সৈন্যকে যুদ্ধের পর অবসর প্রদান করা হয়। জেনারেল মাজীদের উপর দায়িত্ব পড়ে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম অঞ্চলের ঐসকল সৈন্যদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার। তিনি তার উপর প্রেরিত সেই গুরু দায়িত্ব সফলতার সাথে পালন করেন। ১৯৪৬ সালে কোলকাতায় এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত হয়। এই দাঙ্গা দমনে জেনারেল মাজীদ বাংলার সেইসময়ের প্রধানমন্ত্রী হুসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সাথে নিয়ে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে রাত-বিরাত দাঙ্গাকবলিত এলাকা ভ্রমণ করেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরে তিনি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ও তাঁর শ্বশুর স্যার আবদুর রহিমের ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তান চলে আসেন, যদিও তাকে জওহরলাল নেহেরু ও ফিল্ড মার্শাল কে.এম. কারিপ্পা ভারতে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। যদিও জেনারেল মাজীদ সুনামের সাথে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরি করেছিলেন তারপরও তিনি তার সাম্রাজ্যবিরোধী মানসিকতার কারনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বেশ কোনঠাসা অবস্থায় ছিলেন। বেশ কয়েকবার তার চাকরী ছেড়ে দেওয়ার মতো অবস্থাও তৈরী হয়েছিল।
জেনারেল মাজীদ অনেক ন্যায়পরায়ন ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ পাওয়া যায় যে, তিনি কিছুটা বদমেজাজী ছিলেন, মানে তিনি খুব দ্রুত উত্তেজিত হয়ে পড়তেন। ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকা কালিন তার ব্যাক্তিগত রেকর্ড বা ACR পর্যালোচনা করলেও আমরা তার এই বদমেজাজ সম্পর্কে ধারণা পাই। তেমনি একটি ACR এ লখনৌতে তার কমান্ডিং জেনারেল লিখে ছিলেনঃ-
“Majid is an officer of character. But he must train himself to self-restraint and to control this temper however great the provocation. He must remember his position as an officer.” আর ১৯৩৮ সালের ACR নোটে পাওয়া যায়ঃ-
“Nor have there been any unpleasant episodes in his relations with his superiors and subordinates.”
জীবনের অন্তিমলগ্নঃ দেশবভাগের পরে ইশফাকুল মাজীদ পাকিস্তান চলে আসেন এবং তাকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি (জেনারেল অফিসার কমান্ডিং) হিসেবে। তার আগে তিনি উত্তর পশ্চিম সীমান্তের দশম পদাতিক ব্রিগেড ও ৫১তম ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫১ সালের ১৭ই জানুয়ারী আইয়ুব খান পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হন। উল্লেখ্য, জেনারেল মাজীদ ছিলেন জেনারেল আইয়ুব খানের ২ বছরের জ্যেষ্ঠ/সিনিয়র অফিসার। তাই স্বাভাবিক ভাবেই জেনারেল মাজীদ আইয়ুব খানের এই পদোন্নতি সহজভাবে নেননি একইসাথে আইয়ুব খানও জেনারেল মাজীদের শুভাকাঙ্খী ছিলেননা। তিনি সেনাবাহিনীতে জেনারেল মাজীদকে তার পথের কাঁটা হিসেবে ভাবতেন। তাই তাদের দুজনের মধ্যে দ্রুত সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। ১৯৫১ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে একটি সামরিক ষড়যন্ত্র সম্পন্ন হয় যা ইতিহাসের পাতায় “রাওয়ালপিন্ডির ষড়যন্ত্র” নামে পরিচিত। যদিও জেনারেল মাজীদ সেই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত ছিলেননা, তারপরো পাকিস্তান সরকার ও আইয়ুব খান তাকে সেই ঘটনার সাথে ফাঁসিয়ে দেয় এবং তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। কিন্তু, পরবর্তিতে তিনি সসম্মানে সেই অভিযোগ থেকে অব্যাহতি লাভ করেন। এই মামলার থকে অব্যাহতি পেতে জেনারেল মাজীদকে আইনগত সাহায্যসহ বিভিন্নভাবে সাহায্য করেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। পরবর্তীতে জেনারেল মাজীদকে কূটনৈতিক উচ্চপদে চাকরিতে যোগদানের প্রস্তাব করা হয় পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু জেনারেল মাজীদ ছিলেন প্রবল আত্নসম্মানবোধের অধিকারী, নির্লোভ এবং কিছুটা জেদী। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হওয়ায় তার আত্নসম্মানবোধে প্রচন্ড আঘাত লাগে। ফলে তিনি কিছুদিনের মধ্যে চাকরি ছেড়ে দিয়ে সেনাবাহিনী থেকে সেচ্ছায় অবসরগ্রহন করেন।
অবসরগ্রহনের পর কিছুকাল তিনি করাচিতে বসবাস করেন। তারপর ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। ইশফাকুল মাজীদ ছিলেন শান্তিপ্রিয়, শহরের কোলাহল তার ভালো লাগে না। তিনি চেয়েছিলেন জীবনের শেষকটা দিন নীরবে, নিভৃতে শহর থেকে দূরে কোন এক শান্ত পরিবেশে বসবাস করতে। তাই তিনি ঢাকার অদূরে নারায়নগঞ্জে নদীতিরে একখন্ড জমি কিনেন এবং সেখানে বাড়ি বানিয়ে নিভৃতে বসবাস শুরু করেন।
ইশফাকুল মাজীদ খেলাধুলায় অনেক দক্ষ ছিলেন। একজন দক্ষ ক্রীড়াবিদ হিসেবে সেনাবাহিনীতে তার অনেক সুনাম ছিল। বিশেষ করে বক্সিং এ তার অনেক আধিপত্য ছিল এবং একজন ভালো বক্সার হিসেবে অনেক সুনাম কুড়িয়েছিলেন তৎকালীন বোদ্ধা মহলে। চাকরী জীবনে তিনি সৈন্যদের সাথে নিয়মিত ফুটবল ও হকি খেলতেন। খেলাধুলার প্রতি তার এই অনুরক্ততা সম্পর্কে বিশেষভাবে উল্লেখ আছে। খেলাধুলার বাইরে এছাড়া ঘোড়াদৌড়ের উপর তার অনেক দক্ষতে ছিল, একইসাথে তিনি ছিলেন একজন দক্ষ শিকারী। তিনি বাঘ ও বন্যহাতি শিকার করে অনেক খ্যাতি অর্জন করে ছিলেন। তার শিকার করার দক্ষতার ব্যপারে ভালো ধারনা পাওয়া যাবে, তার বাসায় সংরক্ষিত শিকার করে পাওয়া ট্রফিগুলোর দিকে চোখ বুলালে। জেনারেল মাজীদের বিভিন্ন ভাষা শেখার উপর প্রবল আগ্রহ ছিল এবং তিনি বেশ কয়েকটি ভাষায় কথা বলতে পারতেন।
একাত্তরের শুরুর দিকে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশব্যাপি একযোগে শুরু করেন অসহযোগ আন্দোলন যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের অনেক বড় একটি প্লাটফর্ম। ১৯৭১ সালের ২২শে মার্চ তারিখে জেনারেল ইশফাকুল মাজীদের নেতৃত্বে অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যরা বায়তুল মোকাররমের সামনে একটি সমাবেশে এসে সেই অসহযোগ আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করেন। তারা জেনারেল মাজীদের নেতৃত্বে বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত পদযাত্রা করেন। তারপর, সেখান থেকে জেনারেল মাজীদ ও জেনারেল ওসমানী ধানমন্ডী ৩২ নাম্বারে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যান। তারা বঙ্গবন্ধুর হাতে একটি তলোয়ার তুলে দিইয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে জেনারেল মাজীদের অবদান সম্পর্কে জেনারেল জিয়া লিখেছেন,
“He (General Majid) contributed to the liberation war by leading and uniting the retired soldiers.”
২৫শে মার্চের কালোরাত্রির গণহত্যার পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী জেনারেল মাজীদকে বন্দী করে রাখে তৎকালীন মার্শাল ল’ হেডকোয়ার্টারে (বর্তমান সংসদ ভবন এলাকা)। সেখানে কিছুদিন রাখার পর জুলাই মাসে তাকে পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় কারাগারে। পাকিস্তান সরকার তাকে কারাগারে চাপ প্রয়োগ করে বিভিন্ন তথ্য জানতে চায়। বিশেষ করে তার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর অবস্থান সম্পর্কে তথ্য জানতে চায় এবং বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে রাজ শাক্ষী হওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। জেনারেল মাজীদ কালবিলম্ব না করে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে পাকিস্তানি সেনারা তার উপর প্রচন্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করে এবং এক পর্যায়ে তাকে শারিরীকভাবে নির্যাতন শুরু করে। কিন্তু জেনারেল মাজীদ ছিলেন একজন অনেক কঠিন হৃদয়ের মানুষ। এতো অমানুষিক অত্যাচার করার পরেও পাকিস্তানিরা তাকে এক বিন্দুও টলাতে পারেনি। পাকিস্তানিরা পরে বুঝতে পারে যে তাকে কোনভাবেই আয়ত্ব আনা যাবে না। ফলে আগস্টে তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। পাকিস্তান সরকার সেই আগস্ট মাসে দেশের তখনকার অবস্থা নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে, যেখানে জেনারেল মাজীদের সম্পর্কে উল্লেখ ছিল,
“Sheikh Mujibur Rahman appointed Major General (Retired) Majid and Lieutenant Commander (Retired) Moazzem to enlist the retired army personnel in his favor.” [Page-40]
মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে যোগদানের জন্য জেনারেল মাজীদকে প্রস্তাব করা হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু জেনারেল মাজীদ সে সকল প্রস্তাব সসম্মানে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কারন, তিনি সেই বৃদ্ধ বয়সে রাস্ট্রের এতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক ছিলেন না তাছাড়া সেই বয়সে তার পক্ষে এতো দায়িত্বের বোঝা নেওয়াও সম্ভব ছিল না। বরঞ্চ, সেই সময় তিনি তার ফতুল্লার বাড়িতে একাকী নিভভৃতে থাকাটাকেই পছন্দ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। বন্দী থাকাকালীন অমানুষিক নির্যাতনের ফলে তার দেহে বিভিন্ন ধরণের জটিল রোগ বাসা বাঁধতে থাকে। ফলে তিনি শারিরীকভাবে প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৭৬ সালের ৩১শে মার্চ, দিনটা ছিল বুধবার আকাশের নক্ষত্র পড়ে যাওয়ার মত করে আমরা বাঙ্গালি জাতি হারাই আমাদের আকাশেরও আক নক্ষত্রকে। এই দিনে ৭৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন জাতির এই বীর সন্তান। পরেরদিন পহেলা এপ্রিল বড় ক্লান্ত এই বীর সন্তানকে চিরনিদ্রার জন্য শায়িত করা হয় ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে।
তার মৃত্যুর পরে জেনারেল ওসমানী তার এক শোকবার্তায় লিখেছিলেনঃ-
“In his passing away we see almost the end of an era of a gentleman and soldier who went through the toughest conceivable competition, the most honorable and chivalrous profession of any country-that of training and leading armed man in peace and war, through personal example in courage, loyalty, uprightness, selfless, dedication and professional efficiency of an exacting standard, which withstood trails of extremes of climate and terrain. A great gentleman, a great host, evergreen and human yet a very courageous and inspiring leader and a tough senior whom juniors always looked up to with respect and will always remember with highest regard. His death will be deeply mourned in the sub-continent and in different lands of the former British Commonwealth by everyone who knew him.” [The Observer, 2 April 1976]
পরিসমাপ্তিঃ ইশফাকুল মাজীদ ছিলেন একজন আত্নকেন্দ্রিক ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন নির্লোভ ও নিরহংকারী। তার মত যোগ্য ব্যক্তির মূল্যায়ন আমরা কখনো করতে পারিনি। তার এই যোগ্যতাকে সঠিক মূল্যায়ন করতে পারলে এই জাতি আরো অনেক এগিয়ে যেতে পারত। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আর সম্পর্কে খুব কমই তথ্য এবং সৃতিচিন্হ সংরক্ষিত আছে। এই প্রজন্মের কেউ তার সম্পর্কে কিছুই জানে না। তার সম্পর্কে একটা ব্যপার জানা গেছে যে, স্বাধীনতার পরে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে একটি টাকাও বেতন, ভাতা ও রেশন হিসেবে কিছুই নেননি। এ থেকে বুঝা যায় তিনি কতটা নির্লোভ ছিলেন। তার সম্পর্কে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে আরো জানতে হবে। তাকে নিয়ে আরো গবেষনার প্রয়োজন রয়েছে। এই জন্য আমাদের মধ্যে থেকে যেকোন একজনের এগিয়ে আসা উচিত। এইসকল গুণি ব্যক্তিদের নিয়ে গবেষণা আমদের শুধুমাত্র ইতিহাস ও ঐতিহ্যকেই সমৃদ্ধ করবে না একইসাথে আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে পাথেয় হয়ে থাকবে তাদের জীবনি।
তথ্যসূত্রঃ "First Bengali General ISHFAKUL MAJID" by Lt. Colonel Muhammad Lutful Haq (Retd.) Bangladesh Defense Journal
কৃতজ্ঞতাঃ ইফতেখার হাসান পিয়াস।

No comments:

Post a Comment