Saturday, August 13, 2016

১৯ মার্চ ১৯৭১ : সেকেন্ড বেঙ্গল ও জয়দেবপুরের প্রতিরোধ যুদ্ধ

১৯ মার্চ ১৯৭১ : সেকেন্ড বেঙ্গল ও জয়দেবপুরের প্রতিরোধ যুদ্ধ 
-------- মে. জে. (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক


Source LINK 
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ইনফেনট্রি বা পদাতিক কোরে চারটি রেজিমেন্ট ছিল। যথা :
 পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ফ্রন্টিয়ার ফোর্স বা এফ এফ রেজিমেন্ট, বালুচ রেজিমেন্ট ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। 

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত যে রেওয়াজ প্রযোজ্য ছিল, সে মোতাবেক পাঞ্জাব রেজিমেন্টের শতকরা ৯৯ ভাগ জেসিও আর সৈনিক হতেন পাঞ্জাবিভাষী এবং ভৌগোলিকভাবে পাঞ্জাবের অধিবাসী। বালুচ রেজিমেন্টের শতকরা ৯৯ ভাগ জেসিও ও সৈনিক হতেন বালুচিভাষী এবং ভৌগোলিকভাবে বালুচিস্তানের অধিবাসী। ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের শতকরা ৯৯ ভাগ জেসিও এবং সৈনিক হতেন তৎকালীন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অধিবাসী এবং পশ্তু ভাষায় কথা বলার লোক। সে আমলে যেটাকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত বলা হতো, সেটা এখন ‘খাইবার পাখতুন খোয়া’ প্রদেশ নামে পরিচিত এবং সে প্রদেশে প্রাদেশিক সরকার গঠন করেছে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টি। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের শতকরা ৯৯ ভাগ জেসিও এবং সৈনিক হতেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী এবং বাংলাভাষী। যুগপৎ ভাষা ও ভৌগোলিক এলাকার ওপর ভিত্তি করে পদাতিক বাহিনীর রেজিমেন্ট গঠন করার ঐতিহ্য ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ছিল এবং আছে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী থেকে ওই ঐতিহ্য ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে আসে। ১৯৪৭-এর আগস্টে দু’টি আলাদা দেশ হওয়ার পর ওই ঐতিহ্য স্বাধীন ভারতের সেনাবাহিনীতে এবং স্বাধীন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে বহাল থাকে; কিন্তু পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার সময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বলে কোনো রেজিমেন্ট ছিল না। মেজর এম এ গনি নামে (কুমিল্লা জেলার) একজন বাঙালি বীর পুরুষের অকান্ত আগ্রহ ও পরিশ্রম এবং কর্নেল মোহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী নামে একজন লে. কর্নেল ও পরে কর্নেল বাঙালি বীর পুরুষের পরিশ্রম ও পৃষ্ঠপোষকতায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠিত ও বিকশিত হয়েছিল। 
বলাই বাহুল্য, ১৯৪৭-এর আগস্টে তৎকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ২০টির বেশি যুগপৎ ভাষা ও ভৌগোলিক এলাকাভিত্তিক রেজিমেন্ট ছিল পদাতিক কোরে। যথা :
 রাজপুত রেজিমেন্ট, শিখ রেজিমেন্ট, শিখ লাইট ইনফেন্ট্রি, গোর্খা রেজিমেন্ট, মারাঠা রেজিমেন্ট, আসাম রেজিমেন্ট, কুমাউন রেজিমেন্ট ইত্যাদি।
১৯৪৭-এর পরে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে পদাতিক কোরে আরো কয়েকটি রেজিমেন্ট নতুন সৃষ্টি হয়েছে। বহুল প্রচারিত এই নয়া দিগন্ত পত্রিকার সম্মানিত পাঠকদের অনেকেই আশ্চার্যান্বিত হবেন এটা জেনে যে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর পদাতিক কোরে কোনো বেঙ্গল রেজিমেন্ট নেই। এই না থাকার কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা ভারতের কোনো মহল থেকে কোনো দিন দেয়া হয়নি। তবে সম্ভবত হয় পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি জনগণকে ভারতের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ সৈনিক হওয়ার অযোগ্য মনে করেন অথবা তাদের বিশ্বাস করেন না ইত্যাদি কারণ হতে পারে।

বেঙ্গল রেজিমেন্টের কথায় ফিরে আসি। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বলা হতো ফার্স্ট বেঙ্গল তথা সিনিয়র টাইগার্স, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বলা হতো সেকেন্ড বেঙ্গল তথা জুনিয়র টাইগার্স, তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বলা হতো থার্ড বেঙ্গল তথা মাইনর টাইগার্স, চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বলা হতো ফোর বেঙ্গল তথা বেবি টাইগার্স এবং পঞ্চম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বলা হতো ফাইভ বেঙ্গল তথা ভিক্টরি টাইগার্স। আমি ব্যক্তিজীবনে সেকেন্ড বেঙ্গলে চাকরি করেছি, সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তথা লাকি টাইগার্সে চাকরি করেছি এবং ২৫তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তথা মৃত্যুঞ্জয়ী ২৫-এ চাকরি করেছি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে পাঞ্জাব বা বালুচ বা এফ এফ কিংবা যেকোনো রেজিমেন্টেরই হোক না কেন ব্যাটালিয়নগুলো আড়াই থেকে তিন বছর একটা ক্যান্টনমেন্টে থাকত, অতঃপর অন্যত্র অন্য ক্যান্টনমেন্টে বদলি হতো। উদাহরণস্বরূপ, ফার্স্ট বেঙ্গল ১৯৬৫ সালে লাহোর ক্যান্টনমেন্টে ছিল এবং ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তারা লাহোরের সন্নিকটে সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অংশ হিসেবে বীর বিক্রমে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। ওই সময় ফার্স্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক ছিলেন একজন বাঙালি লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি কে হক এবং অন্যতম কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান (পরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি)। আরেকটি উদাহরণ হলো ১৯৬৫ সালে সেকেন্ড বেঙ্গল যশোর সেনানিবাসে ছিল এবং সেপ্টেম্বর মাসের যুদ্ধে নিকটবর্তী সীমান্তে মোতায়েন হয়েছিল, যদিও ওই সীমান্তে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ঘোরতর কোনো যুদ্ধ হয়নি। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর সেকেন্ড বেঙ্গল যশোর থেকে লাহোরে বদলি হয়ে যায়। ১৯৬৮ সালে একই সেকেন্ড বেঙ্গল আবার লাহোর থেকে বদলি হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা শহর থেকে অল্প উত্তরে অবস্থিত জয়দেবপুর নামক স্থানে আসে। যে গ্রামটির নাম জয়দেবপুর, সেটি ছিল পূর্ব বাংলার ইতিহাসের বিখ্যাত জমিদার বংশ, ভাওয়াল রাজাদের রাজধানী। ভাওয়াল রাজবংশের বসবাসের জন্য জয়দেবপুর গ্রামে একটি দৃষ্টিনন্দন রাজবাড়ি বা রাজপ্রাসাদ ছিল (ভবনটি এখনো আছে)। সেকেন্ড বেঙ্গল ওই রাজবাড়িতেই অবস্থান নেয়। ওই রাজবাড়ির চার পাশে  ছিল বাংলার সুনিবিড় শান্তিপ্রিয় গ্রাম। এখন ২০১৪ সালে জয়দেবপুর নাম বা শব্দ বেশি পরিচিত নয়। এখন ওই স্থানটিকে গাজীপুর বলা হয়। কারণ ১৯৮৫ সালে জন্ম নেয়া গাজীপুর জেলার সদর স্থাপন করা হয় জয়দেবপুরেই। ভাওয়াল রাজার রাজবাড়িতে বা রাজপ্রাসাদে গাজীপুর জেলার ডেপুটি কমিশনারের অফিস স্থাপন করা হয়েছে।
সেকেন্ড বেঙ্গলের কথায় ফিরে আসি। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখ পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুল থেকে কমিশন পাই। মহান আল্লাহতায়ালার অশেষ রহমতে কমিশন-পূর্ব চূড়ান্ত মূল্যায়নে আমি আমাদের শ্রেণীতে (সেনাবাহিনীর পরিভাষায় কোর্স-এ) সর্বোত্তম ক্যাডেট বিবেচিত হয়েছিলাম। সেনাবাহিনীর রেওয়াজ অনুযায়ী আমাকে নিয়োগস্থল পছন্দ করে নেয়ার সুযোগ তথা সম্মান দেয়া হয়েছিল। আমি নিজ বিবেচনাতেই উৎসাহিত ছিলাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করার। আমাদের কোর্স-এর প্রত্য প্রশিক তৎকালীন মেজর আর এ এম গোলাম মোক্তাদিরের প্রেরণায় সিদ্ধান্ত নিই দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করার। রেওয়াজ মোতাবেক কর্তৃপ আমাকে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে পোস্টিং দেন তথা নিয়োজিত করেন। ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭০ জয়দেবপুর রাজবাড়িতে অবস্থিত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করে ব্যাটালিয়নের অ্যাডজুটেন্ট হিসেবে পেয়েছিলাম ক্যাপ্টেন এ এস এম নাসিম, উপ-অধিনায়ক হিসেবে পেয়েছিলাম তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান এবং অধিনায়ক হিসেবে পেয়েছিলাম তৎকালীন (বাঙালি) লে. কর্নেল মাসুদুল হাসান খানকে। সাত দিন পর মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম ষোলশহরে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়কের দায়িত্ব নেয়ার জন্য চলে যান। তৎকালীন মেজর কে এম সফিউল্লাহ উপ-অধিনায়কের দায়িত্ব নেন। অন্য বাঙালি অফিসার যারা ছিলেন তাদের পরিচয় এখানে দিয়ে রাখছি ইতিহাসের স্বার্থে। মেজর সফিউল্লাহ ও মেজর জিয়াউর রহমান পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুলের ১২তম লং কোর্সের সদস্য ছিলেন এবং জিয়াউর রহমান মেধা তালিকায় জ্যেষ্ঠ ছিলেন, সফিউল্লাহ কনিষ্ঠ ছিলেন। সফিউল্লাহ বীর উত্তম খেতাব পান এবং স্বাধীন বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর প্রথম সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। ১৯৭৬ থেকে শুরু করে প্রায় ১৯ বছর তিনি রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সাম্প্রতিককালে তিনি সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের উপ-আহ্বায়ক। সফিউল্লাহর পরে জ্যেষ্ঠতার ক্রমঅনুসারে বাঙালি অফিসার যারা ছিলেন তাদের পরিচয়ও তুলে ধরছি। মেজর নুরুল ইসলাম (ডাক নাম শিশু) পরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অধীনে কেবিনেট মিনিস্টার হয়েছিলেন এবং বর্তমানে প্রবীণ বয়সে বিদেশে পরিবারের সাথে বসবাস করছেন। মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রম খেতাব পান, মেজর জেনারেল হয়েছিলেন, সেনাবাহিনীর সদর দফতরে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হয়েছিলেন এবং ১৯৮২ থেকে প্রায় ১৬ বছর রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিন বছর আগে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। ক্যাপ্টেন আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম বীর বিক্রম খেতাব পান, মুক্তিযুদ্ধকালেই নবগঠিত ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হয়েছিলেন, ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান হয়েছিলেন এবং ২০ মে ১৯৯৬ বিতর্কিত পরিবেশে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বীর উত্তম খেতাব পান, পরে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন, একাধিক ডিভিশনের জিওসি ছিলেন, সেনাবাহিনীর সদর দফতরে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল ছিলেন এবং অবসরের আগে বিডিআরের মহাপরিচালক ছিলেন। ক্যাপ্টেন এজাজ আহমেদ চৌধুরী মেজর জেনারেল র‌্যাঙ্ক পর্যন্ত উঠেছিলেন এবং ২০ মে ১৯৯৬ বিতর্কিত ঘটনার পরিপ্রেেিত ১৪ অথবা ১৬ জুন ১৯৯৬ অকালীন অবসরপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান বীর বিক্রম খেতাব পান, মেজর জেনারেল হয়ে বগুড়ায় অবস্থিত ডিভিশনের জিওসি হয়েছিলেন। ২০ মে ১৯৯৬ ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে ‘মহানায়ক’ তিনি ছিলেন এবং ওই পরিস্থিতিতেই ২০ মে ১৯৯৬ রাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন, চার বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌজন্যে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হয়েছেন। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট এম এ মান্নান বীর বিক্রম খেতাব পান এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল র‌্যাঙ্কে এক সময় অবসরে যান। কনিষ্ঠতম সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক খেতাব পান, সেনাবাহিনীর সদর দফতরে ডাইরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশন্স এবং ভাটিয়ারিতে অবস্থিত বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির কমান্ড্যান্টসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৯৫ সালে মেজর জেনারেল র‌্যাঙ্কে প্রমোশন পান ও যশোরে অবস্থিত ডিভিশনের জিওসি হন, ২০ মে ১৯৯৬ বিতর্কিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ জুন ১৯৯৬ অকালীন অবসর পান।
সেকেন্ড বেঙ্গল মূল সেনানিবাস থেকে অনেক দূরে জয়দেবপুরে অবস্থান করার কারণে ব্যাটালিয়নে একজন আর্মি মেডিক্যাল কোরের অফিসার বা ডাক্তার নিয়োজিত ছিলেন। তখন ওই পদে ছিলেন লেফটেন্যান্ট মোক্তার কামাল চৌধুরী। তিনি পরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে প্রসিদ্ধ অর্থোপেডিক সার্জন হয়েছিলেন এবং কর্নেল র‌্যাঙ্কে স্বাভাবিক অবসরে যান।
সেকেন্ড বেঙ্গলের আবাসস্থল জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদে হলেও চার দিকে ছিল বাঙালি গ্রাম। স্থানীয় জনগণের সাথে সেকেন্ড বেঙ্গলের অফিসার ও সৈনিকদের সুসম্পর্ক ছিল। এই তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বা জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ফলাফলে দেখা গিয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টি সংখ্যাধিক্য পেয়েছে। গড়পড়তায় বা দেশব্যাপী হিসেবে বা কেন্দ্রীয় সরকারের হিসেবে পাকিস্তানব্যাপী সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল আওয়ামী লীগ; কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ অঘোষিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে দেবে না। এরূপ পরিস্থিতিতে দেশে এবং সেনাবাহিনীতেও উত্তেজনা বা উদ্বেগ বিরাজ করছিল। পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়নগুলোর ওপর বিশেষ দৃষ্টি রাখা শুরু করে। জয়দেবপুরে অবস্থিত সেকেন্ড বেঙ্গলকে শক্তিহীন করার নিমিত্তে একাধিক অজুহাতে এটাকে বিভক্ত করে ফেলে। একটি কোম্পানিকে মোতায়েন করা হয় ময়মনসিংহ শহরে। একটি কোম্পানিকে মোতায়েন করা হয় টাঙ্গাইল শহরে। একটি কোম্পানির বৃহদংশকে মোতায়েন করা হয় জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদ থেকে অল্প দূরে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র সমরাস্ত্র উৎপাদনকারী কারখানা, যার বর্তমান নাম বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিজ এবং জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদ থেকে আনুমানিক আট মাইল দূরে অবস্থিত রাজেন্দ্রপুর নামক ক্ষুদ্র সেনানিবাসে গোলাবারুদ রণাগারে। ব্যাটালিয়নের অবশিষ্ট অংশ জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদেই ছিল। আমি সে রাজপ্রাসাদেই ছিলাম। ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদুল হাসান খান জয়দেবপুরেই ছিলেন। ঠিক এই সময়টায় পরবর্তী জ্যেষ্ঠ বাঙালি ছিলেন মেজর মইনুল। কনিষ্ঠতম অফিসার হিসেবে সেনাবাহিনীর রেওয়াজ বা ঐতিহ্য মোতাবেক আমি একটি কোম্পানিতে ক্ষুদ্র দায়িত্বে ছিলাম এবং অতিরিক্ত অধিনায়কের সাথে ‘ইনটেলিজেন্স অফিসার’ হিসেবে দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত ছিলাম। উদাহরণস্বরূপ ওই সময় অধিনায়কের চাকরি ছিল ১৯ বছরের বেশি, আর আমার বয়সই চলছিল ২১।
১৯৭০ সালের মার্চ মাস উত্তাল ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে অবিশ্বাস এবং আস্থাহীনতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ওই সময় সেকেন্ড বেঙ্গলের কাছে কিছু অতিরিক্ত অস্ত্র বৈধভাবেই ছিল। সময় ও সুযোগের অভাবে ওই অতিরিক্ত অস্ত্রগুলো কর্তৃপরে কাছে ফেরত বা জমা দেয়া হয়ে ওঠেনি; কিন্তু মার্চ মাসের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় যে,  অতিরিক্ত অস্ত্র জয়দেবপুর থেকে ঢাকায় ফেরত আনতে হবে। একই কর্তৃপক্ষ  আরো সিদ্ধান্ত নেয় যে, যদি সম্ভব হয় সেকেন্ড বেঙ্গলের সব অস্ত্রই কব্জা করে ফেলতে হবে, যেন সেকেন্ড বেঙ্গল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনো রকম বিদ্রোহ করলেও অস্ত্রের অভাবে সেই বিদ্রোহ কার্যকর করতে না পারে। এই দু’টি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য একাধিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, যার বর্ণনা স্থানাভাবে এখানে পরিহার করছি। তবে একটি পদক্ষেপ আজকের তারিখের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং আজকের কলামের অন্যতম প্রতিপাদ্য তা হলো, ১৯ মার্চ ১৯৭১-এর পাকিস্তানি অভিযান এবং তার প্রতিরোধ। 
১৯ মার্চ ১৯৭১ সকালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৫৭ পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাবের নেতৃত্বে ৭২ জন অফিসার ও সৈনিকসংবলিত একটি দল জয়দেবপুরের উদ্দেশে রওনা দেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে এই সফরের কারণ ব্যাখ্যা করা হলো এই বলে যে, জয়দেবপুরে সেকেন্ড বেঙ্গল কেমন আছে, এটা দেখা! ওই সেনাদল সকাল সাড়ে ১০টা-১১টার দিকে রাজপ্রাসাদে এসে পৌঁছায়। স্থানীয় দেশপ্রেমিক বাঙালি জনগণ সব কিছ্ইু অনুসরণ করছিলেন। তারা অনুধাবন করলেন যে, সেকেন্ড বেঙ্গলকে নিরস্ত্র করা হবে। স্থানীয় জনগণ সিদ্ধান্ত নিলেন, এটা হতে দেয়া যাবে না। স্থানীয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ও নেতৃত্বে জয়দেবপুর বাজারে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়ে গেল। জয়দেবপুর রেলস্টেশনে দণ্ডায়মান থাকা মালগাড়ির দু’টি বগিকে টেনে এনে জয়দেবপুর বাজারের কাছে লেভেল ক্রসিংয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো যেন রাজবাড়ি থেকে কেউ বাজারের দিকে যেতে না পারে বা বাজারের দিক থেকে কেউ রাজবাড়ির দিকে আসতে না পারে।
ব্রিগেডিয়ার আরবাবের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানি সেনাদল জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদে এসে সেকেন্ড বেঙ্গলের অফিসার ও সৈনিকদের যুদ্ধংদেহী সাজসজ্জা দেখে, অফিসার ও সৈনিকদের কথাবার্তা শুনে এবং তাদের চেহারায় ফুটে ওঠা অভিব্যক্তি ইত্যাদি অনুভব করে সিদ্ধান্ত নিলো যে, আজ আর সেকেন্ড বেঙ্গলকে নিরস্ত্র করা যাবে না! আজ তাদের অস্ত্র কব্জা করা যাবে না! তারা ভাবলো যে, ইজ্জতের সাথে নিজেরা ফিরে যেতে পারলেই যথেষ্ট। ফেরত যাওয়ার পথে জয়দেবপুর বাজারের কাছে লেভেল ক্রসিংয়ে অবশ্যম্ভাবীরূপেই বাধাপ্রাপ্ত হলো। ব্রিগেডিয়ার আরবাব, সেকেন্ড বেঙ্গলের অধিনায়ক কর্নেল মাসুদুলকে হুকুম দিলেন, যেকোনো নিয়মে প্রয়োজনে গুলি করে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সরিয়ে লেভেল ক্রসিং থেকে মালগাড়ির বগি সরিয়ে আরবাবের সেনাদলের ফেরত যাওয়ার পথ নির্বিঘ্ন করা হোক।  আনুষ্ঠানিকভাবে কর্নেল মাসুদুল হুকুম দিলেন সেকেন্ড বেঙ্গলের ‘ডি’ বা ডেল্টা কোম্পানির অধিনায়ক মেজর মইনুল হোসেনকে। এটা ছিল একটি চরম স্পর্শকাতর পরীক্ষা । পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি মেজর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিক, পাকিস্তানি বা পাঞ্জাবি সিনিয়রদের নির্দেশে জয়দেবপুরের বাঙালি জনতার ওপর গুলি চালায় কি না এটাই ছিল দেখার বিষয়। ওইরূপ উদ্বেগসঙ্কুল পরিস্থিতিতে মেজর মইনুল হোসেন ও তার সঙ্গী অফিসারেরা ও জ্যেষ্ঠ সৈনিকেরা অনেক কৌশলগত পদক্ষেপ নেন। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ কে বুঝ দেয়ার জন্য, জনগণকে লক্ষ্য করে গুলি না ছুড়ে, বরং গাছের আগায় ও কচুরিপানা লক্ষ্য  করে অল্প গোলাবর্ষণ করা হয়। অপর পক্ষে স্থানীয় হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ  জনতাও কঠিন পরীক্ষার সামনে ছিল। তারা চাচ্ছিল পাকিস্তানি বা পাঞ্জাবি সেনাদলকে  আক্রমণ করতে বা পর্যুদস্ত করতে; কিন্তু পাকিস্তানি বা পাঞ্জাবি সেনাদল এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদল রেললাইনের একই দিকে হওয়ায় বিক্ষুব্ধ জনগণের পক্ষেও  সিদ্ধান্ত ও  পদক্ষেপ  গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। জনগণ তাদের কাছে যেকোনোভাবেই রাখা বা পাওয়া স্থানীয় বন্দুক এবং একটি মারাত্মক ঘটনার মাধ্যমে পাওয়া পাঁচটি চাইনিজ রাইফেলের দু-একটি ব্যবহার করেছিল। স্থানীয় জনতা পাকিস্তানি বা পাঞ্জাবি সেনাদেরকে লক্ষ্য  করে গোলাগুলি করে। বাঙালি মেজর মইনুলকে ব্রিগেডিয়ার আরবাব, কর্নেল মাসুদুলের সামনেই অনেক ধমকা-ধমকি করে এবং শাস্তির ভয় দেখায় এই মর্মে যে, ‘কী গোলাগুলি করলা যে এখনো ১০টা লোকও মরে নাই’? মেজর মইনুলও মোটামুটিভাবে কৌশলগত কথার ইশারায় জানিয়ে দিলেন, নিরস্ত্র বাঙালি জনতার ওপর গুলি করা যাবে না। পরিস্থিতির যেন আরো অবনতি না হয়, তাই বেঙ্গল রেজিমেন্টের জ্যেষ্ঠ অফিসারেরা এবং স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতারা উদ্যোগ নিলেন। সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের মধ্যে অনেকেই এখনো জীবিত আছেন এবং দু’জন সুপরিচিত। তাদের একজন হলেন বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এবং অপরজন হলেন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। আরেকজন এখন জীবিত নেই। তিনি ছিলেন শ্রমিক নেতা ও সংগঠক আবদুল মোত্তালিব চৌধুরী। এই তিনজন সাত দিন পরেও সেকেন্ড বেঙ্গলকে সাহায্য করেছিলেন।
দুই ঘণ্টার অধিক সময়ের খণ্ডযুদ্ধের পর বিক্ষুব্ধ জনতা সম্মত হয়েছিল মালগাড়ির খালি বগিগুলো সরিয়ে নিতে। ফলে ঢাকা সেনানিবাস থেকে সকালে আগত সেনাদল ঢাকা ফেরত যাওয়ার জন্য রওনা দেয়। যাওয়ার পথে তারা বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনরত বাঙালিদের ওপর গুলি করে এবং অনেক মানুষ নিহত হয়। ব্রিগেডিয়ার আরবাব, সেকেন্ড বেঙ্গলের অধিনায়ক কর্নেল মাসুদুলকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন এবং ঢাকা চলে আসতে বলেন। দৃশ্যত বা আনুষ্ঠানিকভাবে যে অজুহাতই দেয়া হোক না কেন, আসল কারণ ছিল ওটা, যেটা প্রকাশ করা যাবে না। অর্থাৎ পাকিস্তানিদের মূল্যায়নে সেকেন্ড বেঙ্গল মনেপ্রাণে বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছে এবং অধিনায়ককে অপসারণ করলে তাদের সমতা কমে যাবে। ২৩ মার্চ কর্নেল মাসুদুল চলে যান এবং পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কর্মরত জনৈক বাঙালি লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাকিবকে সেকেন্ড বেঙ্গলের নতুন অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। ১৯ মার্চ অপরাহ্ণে, ব্রিগেডিয়ার আরবাব অনেক কঠোর ও অশোভন ভাষায় সেকেন্ড বেঙ্গলকে ধমকাধমকি করে যান। স্বীকার করতেই হবে যে, দুই ঘণ্টার অধিককালব্যাপী একটি খণ্ডযুদ্ধের বর্ণনা শুধু চারটি অনুচ্ছেদের মধ্যে দেয়া কঠিন কাজ; কোনো না কোনো কথা বাদ থেকেই যেতে পারে অথবা কোনো না কোনো দিক যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে উল্লেখ না-ও হতে পারে। এই সীমাবদ্ধতা অনিচ্ছাকৃত। কনিষ্ঠতম অফিসার হওয়ার সুবাদে ব্যাটালিয়নের সদর দফতরে ‘ইনটেলিজেন্স অফিসার’ হিসেবে দায়িত্ব পালনের অজুহাতে, ম্যাপ বা মানচিত্র ও ওয়্যারলেস সেট ইত্যাদি হাতে নিয়ে সর্বদাই অধিনায়ক কর্নেল মাসুদুলের কাছাকাছি সরেজমিনে অবস্থান করতে হতো বিধায় বা অবস্থান করার সুযোগ পাওয়ায় ওই দুপুর ও বিকেলের ঘটনাপ্রবাহ নিজ চোখে দেখা এবং নিজের হৃদয় দিয়ে অনুভব করার সুযোগ পেয়েছিলাম। জাতির উদ্বেগসঙ্কুল এক মুহূর্তে ১৯ মার্চ ২০১৪ পত্রিকার মাধ্যমে জনগণকে সে দিনের কিছু অভিজ্ঞতা জানালাম।
১৯ মার্চের ঘটনায় স্থানীয় বাঙালি জনগণ প্রমাণ করেছিলেন যে, বাঙালির মনে স্বাধীনতার প্রজ্বলিত শিখা অতি উজ্জ্বলভাবে জ্বলছিল। একই ঘটনা প্রমাণ করেছিল, বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালিরা বাঙালির চরম মুহূর্তে জাতির প্রতি অনুগত ছিল। সাত দিন পর ২৬ মার্চ আসে। সেকেন্ড বেঙ্গলের যে দু’টি অংশ ময়মনসিংহ শহরে এবং টাঙ্গাইল শহরে ছিল তারা ২৬ মার্চেই বিদ্রোহ করে। রাজেন্দ্রপুরে ও সমরাস্ত্র কারখানায় পাহারারত সৈনিকেরাসহ জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদে অবস্থিত মূল অংশ সেকেন্ড বেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক মেজর কে এম সফিউল্লাহর আনুষ্ঠানিক নেতৃত্বে ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের লক্ষ্যে রাজপ্রাসাদ তথা জয়দেবপুর ত্যাগ করে।
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
১৯ মার্চ ২০১৪ দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত।

No comments:

Post a Comment