নব্য উপনিবেশ ও ষড়যন্ত্রের জিঞ্জিরে মুসলমান-১:
ড. এম. সাইদুল ইসলাম
Source Link
( Published on 06 February 2012 in the Source Link )মুসলিম উম্মাহ আজ চরম সংকটের আবর্তে নিমজ্জিত এবং ভয়াল ষড়যন্ত্রের জিঞ্জিরে আবদ্ধ। একদিকে ইঙ্গ-মার্কিন-ইহুদি জোটের ষড়যন্ত্রের বিষাক্ত থাবা অন্যদিকে ব্রাহ্মন্যবাদের করাল গ্রাস। একদিকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের নগ্ন চিত্র, অন্যদিকে নব্য-উপনিবেশের ভয়াবহ আলামত। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম শিখরে যেখানে বিশ্বের অবস্থান, যেখানে চলছে আন্তর্জাতিক বাজারসমূহ দখলের তীব্র প্রতিযোগিতা, সেখানে মুসলমানেরা আজ নিজেদের রসদ যোগাতেই ব্যর্থ। শুধুমাত্র কিছু ভৌগলিক এলাকা ছাড়া মুসলামানেরা সবই ছিলো ইউরোপীয় ও আমেরিকান আগ্রাসী শক্তির হাতে। আজ সেটাও হাতছাড়া হবার উপক্রম! মুসলামানদেরকে তাদের ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করে লুন্ঠিত সম্পদ ভাগ-বাটোয়ারার নগ্ন উল্লাসে মেতে উঠেছে ওরা। এই ভয়াল ষড়যন্ত্রের সাথে হাত মিলিয়েছে মুসলিম নামধারী কিছু মোনাফেকেরও দল। ইহুদিবাদের (Zionism) এটা একটা চরম সাফল্যের যে, তারা তাদের নিজেদের স্বররথকে ইঙ্গ-মার্কিন স্বার্থের সাথে একাকার করে মিশিয়ে ফেলেছে। দীর্ঘ দিন ধরে যন্ত্রনাক্লিষ্ট মুসলিম বিশ্বকে আরো পঙ্গু এবং চিরতরে অন্ধ করে দেওয়ার জন্য বাদ-বাকী কাজগুলো করানো হচ্ছে ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসী শক্তি দ্বারা। এর সূচনা পর্ব অনেক পূর্বের ইতিহাসের গ্রোন্থিত থাকলেও প্রকাশ্য আলামত শুরু হয় আফগানিস্তানের মত স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের উপর আক্রমণের মধ্য দিয়ে। আফগানিস্তানের থকে আগ্রাসী থাবা আঘাত হানলো ইরাকের উপর। সিরিয়া ও ইরান পরবর্তি টার্গেট। ইঙ্গ-মার্কিন লিষ্টে যে আরো ডজনখানি মুসলিম দেশের নাম রয়েছে তার আভাস এখন পাওয়া যাচ্ছে। উপনিবেশের সেই ভয়াল ইতিহাসের আবর্তন আজ সুষ্পষ্ট লক্ষ্যণীয়। এ ভয়ংকর আগ্রাসী থাবা যে কোথায় গিয়ে থামবে তা কেবল আল্লাহ মা’বুদই জানেন। মুসলিম বিশ্বেকে নিয়ে নগ্ন ষড়যন্ত্রের রুপ ও পরিধি বুঝতে হলে সমকালীন বিশ্বের অনেক জটিল বিষয়াদি সম্পর্কে আমাদের সাম্যক ধারণা থাকতে হবে। এ নিবন্ধে ইঙ্গ-মার্কিন- ইহুদি চক্রের মুখোশ উন্মোচনের প্রয়াস চালান হয়েছে সংক্ষিপ্ত পরিসরে। মুসলমানেরা কেন ষড়যন্ত্রের জালে জড়িয়ে গেলো এবং ষড়যন্ত্র মকাবেলায় তারা কেন বার বার মুখ থুবড়ে পড়ছে- সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। এ নিবন্ধের শেষাংশে এই জটিল প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়েছে। উপনিবেশিক ও ষড়যন্ত্রের জিঞ্জিরঃ কয়েক শতাব্দী হলো চরম সংকটের আবর্তে নিমজ্জিত আছে মুসলিম উম্মাহ। সংকটের পরিধি ক্রমশ বাড়ছে ছাড়া কমছে না। বর্তমানে তা এক মারাত্নক রুপ পরিগ্রহ করেছে। কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অবর্তমানে দিকনির্দেশনাহীন মুসলিম উম্মাহ আজ নিপতিত চরম ফেৎনা-ফ্যাসাদ এবং কোন্দলে। এসবের সুযোগ নিয়ে উপনিবেশিক শক্তির যে বিষাক্ত নখরের দাগ মুসলিম বিশ্বের উপর পড়েছিলো, সেগুলো শুকাতে না শুকাতেই নব্য এবং ধারালো থাবা নিয়ে আবির্ভূত হলো ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে ১৯২৪ সালে পতন হয় মুসলমানদের সর্বশেষ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ওসমানিয়া খেলাফত (Ottoman Empire)। মুসলমানেরা হয়ে পড়ে নেতৃত্বশূন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুসলিম বিশ্বের খন্ড খন্ড অংশ নিয়ে গঠিত হতে থাকে জাতী রাষ্ট্রের (Nation State)। আঞ্চলিকতা, ভাষা, এবং অন্যান্য গোত্রীয় বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রগুলো গঠিত হয়। এক মুসলিম বিশ্ব ভেঙ্গে গঠিত হয় পঞ্চাশটিরও বেশি দেশ; বেশ কিছু ভূখন্ড হয় হাতছাড়া। এগুলোর মধ্যে ভারত, সাবটা, মালিলা, ফিলিস্তিন, মধ্য এশিয়ার দেশসমূহ, স্পেন; আলবেনিয়া, বসনিয়া, চেচনিয়াসহ ইউরোপের ব্যাপক এলাকা; ফিলিপিন, সিঙ্গাপুর, চীনের ক্যান্টন ও উরুগুয়েস্তান, থাইল্যান্ডের পাতানী প্রদেশ এবং আফ্রিকা মহাদেশের বেশ কয়েকটি দেশ। এগুলোর অধিকাংশই অমুসলিম দেশ হিসাবে এখন পরিচিত, অথচ এগুলো মুসলিম খেলাফতের অন্তর্ভূ্রক্ত ছিলো দীর্ঘ কাল। উপনিবেশিক শক্তিগুলো মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ ভূখন্ড দখলের পর মুসলমানদেরকে যেমন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেওলিয়া বানালো, অন্যদিকে তাদের মানের ইসলামী চিন্তা-চেতনা নির্মুল করে তথায় পাশ্চাত্য সভ্যতার আদর্শ সমূহ প্রেন্থিত করলো। ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ বা ইসলাম পরিণত হলো গৌণ বিষয়ে। ফলে দেখা দিল মুসলমানদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক শক্তিসমূহই কেবল উপনিক শক্তিগুলো হস্তগত হলোনা, বরং মুসলমানদের মন-মস্তিষ্কও পাশ্চাত্য চিন্তাধারার ধোলাই হয়ে উপনিবেশের শৃঙ্গখলে আবদ্ধ হলো। উপনিবেশের জিঞ্জিরে আবদ্ধ মুসলিম নামধারী ধর্মনিরেপেক্ষরা টের পেলোনা যে তারা এক নব্য শৃংখলে অবদ্ধ, বরং উল্টো তাদের মানসিক রূপান্তরকে ‘প্রগতিবাদ’ হিসাবে গুরুত্ব পায়, তখন তারা যে মুসলিম অট্টালিকার ভিতে উইপোকার অস্তিত্বের ন্যায় বিপদজনক- তা সহজেই অনুমান করা যায়। আর এরাই যখন বিভক্ত এবং স্বাধীনতা প্রাপ্ত মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর শাসনভার গ্রহন করলো, তখন একদিকে যেমন ইসলাম প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ইসলামকে সুযোগমত ব্যবহারপূর্বক রাষ্ট্রকে ইসলাম-বহির্ভূত (de-Islamize) করার চেষ্টা করলো, অন্যদিকে পাশ্চাত্যের নোংরা খেলায় তারা বলদের (Muslim bulls in Western dirty game) ভূমিকা পালন করলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রত্যক্ষ উপনিবেশ থেকে একে একে হাতগুটিয়ে নেয় ইউরোপীয় উপনিবশিক শক্তিগুলো; কিন্তু নব্য শক্তি রুপে আবির্ভূত হয় আমেরিকায়। চলতে থাকে পরোক্ষ বা নব্য উপনিবেশ (Neo-colonization)। এতে আক্রান্ত হয় মুসলিম বিশ্বসহ অমুসলিম বিশ্বেরও বড় অংশ। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে আমেরিকান আগ্রাসন চলে বিশ্বব্যাপী। আর এতে বলি হয় বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষ। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে আমেরিকা ২০ লক্ষ ভিয়েতনামী নাগরিককে হত্যা করে। জাতিসংঘের এক তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুসারে আমেরিকার সহযোগীতায় গুয়েতমালার (মধ্য আমেরিকার একটি দেশ) সরকার ২ লাখ জনগণের ৯০ ভাগকে হত্যা করে। কম্বোডিয়াতে আমেরিকার সহযোগীতায় নিহতের সংখ্যা ১২ লাখ, ফিলিপাইনে ৩ লাখ এবং নর্থ কোরিয়াতে ৮০০০। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এতসব হত্যাকান্ডের কোন তদন্ত এবং বিচার হয় নাই। আমেরিকার পরিভাষায় এই হত্যাযজ্ঞ ‘গণতন্ত্রের মূল্য’ (Price for Democracy)। আমেরিকার এই বিষাক্ত হানা মুসলিম বিশ্বকে তছনছ করে ছেড়েছে। সুদান ও সোমালিয়াতে হত্যা করা হয় হাজার হাজার নিরিহ মুসলমানকে। আমেরিকার চোখের সামনে সার্বিয়ানরা হত্যা করে ১০,০০০ কসোভার মুসলমানকে। হাজার হাজার বসনিয়ান এবং চেচনিয়ান মুসলমানকে হত্যা করে প্রতিবেশীরা। আমেরিকার সমর্থনপুষ্ঠ ইসরাইল প্রতিনিয়ত হত্যা করছে ফিলিস্তিনের মুসলমানদেরকে। ১১ই সেপ্টেম্বর ২০০১ এর পর আমেরিকা মুসলিম নিধনে মেতে ওঠে। সন্ত্রাসী হামলার পশ্চাতে কোন সুস্পষ্ট যোগসুত্র এবং কারণ দেখাতে ব্যর্থ হয়ে নিজেই উকিল এবং বিচারক সেজে সব দায়িত্ব আমেরিকা চাপায় আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের উপর। আমেরিকার সাথে যুদ্ধে প্রাণ হারায় ৮০,০০০ আফগান নাগরিক। ৩,০০০ কয়েদিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে আমেরিকা। প্রত্যক্ষ আগ্রাসনের থাবা আফগানিস্তান থেকে বিস্তার করা হয় ইরাকের উপর। এমনিতেই আমেরিকার দেয়া অবরোধ ১৯৯১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ১৮ লক্ষ ইরাকী শিশু মৃত্যুবরণ করে। বর্তমান ইরাক যুদ্ধ এবং যুদ্ধপরবর্তী আমেরিকার পরিকল্পনাসমূহ আমেরিকার আগ্রাসী উপনিবেশিক এবং মুসলিম বিদ্বেষী চেহারার এবং নগ্ন স্বার্থের বহিঃপ্রকাশ। একটু ভিতরে গেলে আমেরিকার আসল চেহারা ফুটে উঠবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গনের পর বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী (যাদের অধিকাংশই ইহুদী) বিশ্ব ব্যবস্থাকে ‘এক মেরুকেন্দ্রীক’ (Unipolar) হিসাবে বুদ্ধিবৃত্তিক তত্ত্ব বের করে; যেখানে আমেরিকাই পরাশক্তি যে বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। বুদ্ধিজীবীদের এ ধরণের চিন্তা-ভাবনার (Intellectual Constriction) দুটো চরম নেতিবাচক দিক রয়েছে। প্রথমত, ইহা আমেরিকাকে বিশ্বের বুকে এক অসামান্য আসন দান করলো এবং বিশ্বব্যাপী যেকোন মূল্যে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য আমেরিকাকে উষ্কানী দিলো। দ্বিতীয়ত, আমেরিকান সভ্যতার পাশাপাশি অন্যান্য সভ্যতাও যে সহঅবস্থান করতে পারে বা করার যোগ্যতা রাখে -সে সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ নাকচ করে দিলো। ভাবখানা এমন, বিশ্বে এখন চলবে শুধু আমেরিকান সভ্যতার জয়-জয়কার; আর অন্যান্য সভ্যতা সমূহ হয় নিশ্চিহ্ন হবে, নতুবা পরাজিত শক্তি হিসাবে আমেরিকার অধীনে থাকবে। উরেহরণ স্বরূপ আমরা হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ইহুদি প্রফেসর স্যামুয়েল হানটিংটনের সভ্যতার দ্বন্দ্ব (The Clash of Civilization) নামক তত্ত্বের কথা উল্লেখ করতে পারি। উক্ত তত্ত্বে তিনি উল্লেখ করেন যে, ভবিষ্যতে আমেরিকান সভ্যতার সাথে প্রাচ্যের ইসলামী এবং চাইনীজ সভ্যতার দ্বন্দ্ব হবে। তিনি আমেরিকাকে পরামর্শ দেন যে এ দ্বন্দ্বে জিততে হলে প্রাচ্যের সামরিক এবং অর্থনৈতিক উত্থানকে যেকোন মূল্যে নস্যাৎ করতে হবে। অনেক সমালোচক এই ধরণের তত্ত্বকে পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবীদের ‘নরঘাতী ভ্রান্তি’ (Homicidal Blunder) হিসাবে উল্লেখ করেন। কারণ এইসব তত্ব বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন জাতি ও সভ্যতার লোকদের শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের (Peaceful co-existence) পথ রুদ্ধ করে আমেরিকাকে সামরিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বজায় রাখা এবং জোরদার করার পরামর্শ দিলো। চরম দুঃখের বিষয়, আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতি এইসব তত্ত্বের ভিত্তিতেই রচিত। এই আগ্রাসী পররাষ্ট্র নীতির পাশাপাশি আমেরিকার রাজনৈতিক কাঠামোতে সামরিকায়নের বিষয়টি (Militarization of American Political Structure) আজ সুস্পষ্ট। আমেরিকার প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনী দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র ব্যবসায় জড়িত, প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রি কলিন পাওয়েল অবসরপ্রাপ্ত আর্মী জেনারেল, যিনি উপসাগরীয় যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এ ধরণের আরো অবসরপ্রাপ্ত আর্মী জেনারেল রয়েছেন আমেরিকান সিনেটে। কাজেই আমেরিকান প্রশাসন সারা বিশ্বকে দেখছে আর্মী মতাদর্শের (Army ideology) দৃষ্টি দিয়ে, যার মূলমন্ত্রই হলো যুদ্ধ, হত্যা এবং বিনাশ সাধনের মধ্য দিয়ে ভোগ দখল। এই কারণে বুশ এবং বর্তমান প্রশাসনে যোগ হয়েছে নতুনরীতি যেটাকে বলা হয় ‘নিবৃত্তিমূলক অতর্কিত হামলা’ (The doctrine of pre-emptive attack)। এর অর্থ হলো- কোন দেশ বা জাতীকে থ্রেট বা ঝুঁকি মনে করে সত্যকারের থ্রেট আসার আগেই অতর্কিত হামলা করা। হিটলার এই রীতিকে ব্যবহার করে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্মদেয়। দীর্ঘদিন ধরে পেন্টাগন (আমেরিকান আর্মী) এবং আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা Central Intelligence Agency (CIA) ‘উষ্কানী রীতি’ (Policy of Instigation) অবলম্বন এবং ব্যবহার করে আসছে। এর অর্থ হলো, আমেরিকা যদি কোন স্থানে তার উপস্থিতি এবং আগ্রাসন নিশ্চিত এবং ন্যায্যতা প্রতিপাদন করতে চায়, তাহলে CIA এবং পেন্টাগনের সহযোগিতায় সেখানে কোন বিশেষ দল বা গোত্রকে অর্থ এবং অস্ত্রসস্ত্র প্রদান পূর্বক তাদের দ্বারা তথায় একটা কৃত্রিম সংকট (artificial crisis) তৈরী করে। পরবরতীতে ঐ সংকট নিরাসনের নাম নিয়ে আমেরিকা তার উপস্থিতি এবং আগ্রাসনকে নিশ্চিত করে। এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রমাণ বর্তমান যে, CIA এর সহযোগিতায় সাদ্দাম পূর্বের সরকার প্রধান আব্দুল কাসিমকে হত্যা করে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। আমেরিকার উষ্কানিতেই সাদ্দাম হুসাইন ইরান এবং পরে কুয়েত আক্রমণ করেন। এমনকি, ওসামা বিন লাদেনও আমেরিকার সৃষ্টি। আমেরিকার ‘উষ্কানী রীতি’র সাথে ইংরেজ উপনিবেশের “বিভক্তকরণ পূর্বক শাসন রীতির” (Divide and Rule and Policy) বেশ মিল পাওয়া যায়। খবরটি শুনে অনেকে অবাক হবেন যে, আফগানিস্থানের উপর আমেরিকার আক্রমণের সিদ্ধান্ত ১১ই সেপ্টম্বর সন্ত্রাসী হামলার দুই মাস পূর্বে গৃহিত হয়। ভারতের নেহেরু কাউন্সিলের চেয়ারম্যান প্রফেসর ইজাজ আহমেদ এক তালেবান জেনারেলের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে, আফগানিস্তান আমেরিকা কতৃক আক্রান্ত হওয়ার তিন মাস পূর্বে আমেরিকা এবং তালেবান সরকারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং উক্ত বৈঠকে আফগানিস্তানের উপর দিয়ে তেলের পাইপলাইন তৈরীর ব্যাপারে মতবিরোধ দেখা দেয়। আমেরিকা চেয়েছিলো আফগানিস্তানের উপর দিয়ে পাইপলাইন নির্মাণ পূর্বক মধ্য এশিয়া থেকে তৈল সংগ্রহ করতে। বৈঠকেই আমেরিকা জানিয়ে দেয় যে তাদের প্রস্তাবে রাজি না হলে তিন মাসের মধ্যেই আফগানিস্তান আক্রান্ত হবে। ঠিক তিন মাস পরেই আফগানিস্তান আক্রান্ত হয়। এর মধ্যেই ঘটে যায় সেপ্টেম্বর-১১’র সন্ত্রাসী হামলা, যা আমেরিকান আগ্রাসনকে বৈধতা দান করে। এসব কিছুর মূলে রয়েছে দুটো বিষয়ঃ তৈল এবং ইসরাইল। টরেন্টো সান (Toronto Sun) পত্রিকার একজন সম্পাদক ইরিক মারগুলিসের মতে, আমেরিকা পূর্বে তার চাহিদার একতৃত্বীয়াংশ তৈল আমদানি করতো, বর্তমানে আমদানি করে চাহিদার অর্ধেক, এবং কয়েক বছর পরে আমদানি করতে হবে চাহিদার দুইতৃতীয়াংশ। এজন্য অদুর ভবিষ্যতে নিশ্চিত তৈল সংকটের বিষয় নিয়ে বর্তমান আমেরিকান প্রশাসন খুবই তটস্থ। সর্বপরি, বিশ্বরাজনীতিতে তৈল একটি বড় শক্তির নিয়ামক এবং প্রেসিডেন্ট বুশ পরিবারের রয়েছে বিলিয়ন ডলারের তৈল ব্যবসা। সব আন্তর্জাতিক আইনকে তোয়াক্কা করে আমেরিকা কতৃক ইরাক আক্রমণের পশ্চাতে রয়েছে তৈল স্বার্থ। কারণ ইরাকে রয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল সঞ্চয় (বিশ্বের ১৭ ভাগ)। আমেরিকার পরিকল্পনা- ইরাক দখল পূর্বক তথায় হামিদ কারজাই’র মতো একজন পুতুল সরকার বসানো এবং এভাবে অপেকের (OPEC) ক্ষমতাকে নস্যাৎ করে তৈলের মূল্য নির্ধারণের কতৃত্বভার গ্রহণ করা। ধারণা করা হচ্ছে, আমেরিকা ইরাককে কয়েকভাগে বিভক্ত করে ইরাকের শক্তিকে চিরতরে খতম করবে, যাতে ইসরাইলের জন্য কোন রকম হুমকি হতে না পারে। উল্লেখ্য, ইসরাইল হলো আমেরিকার ঘনিষ্ট বন্ধু এবং প্রতিবছর আমেরিকা হতে সামরিক সহায়তা হিসাবে পায় ২.২ বিলিয়ন ডলার। আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়নে ইসরাইল এবং আমেরিকার ইহুদীদের রয়েছে চরম প্রভাব। একবার ইসরাইল প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শারন জোর গলায় বলেছিলো “আমরাই আমেরিকার সিনেট নিয়ন্ত্রণ করি।” ক্ষমতায় আসার পর এরিয়েল শারন প্রেসিডেন্ট বুশের সাথে দেখা করেন ১৭ বার, যা বুশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ব্রিটশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের সফর সংখ্যা থেকেও বেশী। ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ইসরাইলী আগ্রাসন, হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের জন্য জাতিসংঘে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ৬৫টি প্রস্তাব (Resolution) পাশ হয়, যার কোনটাই ইসরাইল রক্ষা করে নাই। ইসরাইলী নৃশংসতাকে আড়াল করার জন্য এবং ইসরাইলকে সমালোচনা থেকে বাঁচানোর জন্য ১৯৭২ সালের সেপ্টম্বর থেকে ১৯৯০ সালের মে মাস পর্যন্ত ইসরাইলের বিরুদ্ধে আনিত প্রস্তাব নাকচ করার জন্য আমেরিকা ৩০ বার ভেটো প্রদান করে। জায়োনিষ্টদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ইসরাইল রাষ্ট্রের পরিধী হবে নীল ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তি সকল এলাকা। যার মধ্যে রয়েছে সিরিয়া, কুয়েত, মিশর ও মদীনা। ইহুদীদের এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রাথমিক বাধা হলো ‘ফিলিস্তিনী রাষ্ট্র’। এজন্য ইসরাইল সব সময় ফিলিস্তিনী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোদকে বিরোধিতা করে আসছে। ইরাক যুদ্ধের ক্ষেত্রে ইসরাইলের রয়েছে দুটো দীর্ঘ মেয়াদী এবং দুরদর্শী পরিকল্পনা। প্রথমত, ইরাকের শক্তিকে খর্ব করার মধ্য দিয়ে ইসরাইল ইরাকের হুমকিমুক্ত হবে। দ্বিতীয়ত, ইরাকের এবং পরবর্তিতে সিরিয়া ও ইরানের (যে যুদ্ধসমূহ আসন্ন) দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইসরাইল তার ভোগ দখল প্রক্রিয়া (Occupation) জোরদার করছে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইরাক, সিরিয়া এবং ইরানের বিনির্মানের জন্য দরকার হবে সস্তা শ্রমিকের। পশ্চিমতীর এবং গাজা এলাকার ইসরাইল কতৃক দীর্ঘ-লাঞ্চিত-বঞ্চিত-দারিদ্র ক্লিষ্ট-বেকার ফিলিস্তিনী যুবকেরা তখন কাজের সন্ধানে গমন করবে ইরাক, সিরিয়া এবং ইরানে। ইসরাইল তখন সহজেই দখল করতে পারবে ফিলিস্তিনের বাকি এলাকাসমূহ। ইরাকে এবার নিহত হলো হাজার হাজার নিরিহ মানুষ, ধ্বংস হলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে তোলা সভ্যতার ইমারত, গৃহহারা হলো কয়েক লাখ লোক, লুট হলো অতি প্রাচীন মেসোপোটেমিয়ান সুমেরীয়, পারস্য এবং ইসলামী সভ্যতার অতি মূল্যবান নিদর্শন সমূহ। আর এসব কিছুই আমেরিকা করলো, ‘ইরাকের গণবিধ্বংসী অস্ত্র’, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’, ‘ইরাককে মুক্তকরণ’, ‘শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন’- প্রভৃতি বাগাড়ম্বরপূর্ণ (rhetorical) শ্লোগান সমূহ ব্যবহার করে। এর থেকে বড় প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, ধোকাবাজী, প্রহসণ আর কি হতে পারে? আমেরিকার ইহুদীগোষ্ঠি কয়েক দশক আগে ইউরোপে যাদের অবস্থান ছিলো প্রচন্ড নাযুক- খ্রিষ্টানদের সাথে যাদের ছিলো প্রচন্ড ব্যবধান এবং শত্রুতা –তারা আজ কতকগুলো বিষয়ে সফলকামঃ ১। বিশ্বরাজনীতির প্রধান শক্তি সমূহ আজ তাদের হাতে- অর্থনীতি, মিডিয়া, শিক্ষা, সামরিক শক্তি- সবই নিয়ন্ত্রণ করছে ওরা। বর্তমানে আমেরিকান প্রশাসনে রয়েছে ৩৫ জনের মত ইহুদী। ২। তারা তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাধনার বলে তাদের এবং খ্রিষ্টানদের মধ্যকার বিশাল ব্যবধান কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। ৩। তাদের নিজেদের স্বার্থকে আমেরিকান স্বার্থের সাথে একাকার করে মিশিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। ইরাক আক্রমণের ফলাফলই তার বাস্তব প্রমাণ। ৪। পাশ্চাত্যের সাথে ইসলাম এবং মুসলমানদের দুরত্ব নির্মাণেও তারা অনেকটা সফল। পাশ্চাত্যে মিডিয়াতে তারা ইসলাম ও সন্ত্রাসবাদকে একাকার করে ফেলেছে।
No comments:
Post a Comment