Thursday, May 14, 2015

গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ড

1) নিউইয়র্ক টাইমসে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন : শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যায় সরকার জড়িত ... LINK 
Published on ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২

বাংলাদেশ সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীই আলোচিত গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামকে হত্যা করেছে বলে অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস। আমিনুল হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে গতকাল দৈনিকটির প্রিন্ট সংস্করণে প্রধান প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী বিশেষ করে এনএসআই আমিনুল হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারে। হত্যার আগে একাধিকবার তাকে অপহরণ, গ্রেফতার ও নির্যাতন করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। তাকে হত্যারও হুমকি দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু আমিনুলকে হত্যায় কেন জড়িত থাকবে সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী? অনুসন্ধানে এরও জবাব খুঁজেছে নিউইয়র্ক টাইমস। আড়াই হাজারেরও বেশি শব্দের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়,
সরকার জাতীয় ভাবমূর্তির জন্য আমিনুলকে হুমকি হিসেবে দেখত। এক শ্রমিক ওয়েবসাইটে আমিনুল ২০১০ সালে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তার অপহরণ ও নির্যাতনের কাহিনী প্রকাশ করেন। চলতি বছরই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী টিভি স্টেশন এবিসি নিউজের একটি প্রতিবেদনে শ্রমিকদের সাক্ষাত্কারের ব্যবস্থা করে দেন। টিভি স্টেশনটি বাংলাদেশের গার্মেন্ট কারখানায় শ্রমিকদের অনিরাপদ কর্মপরিবেশ নিয়ে রিপোর্ট প্রচার করে। হামীম গ্রুপের একটি কারখানায় আগুন লেগে ২৯ জন শ্রমিক মারা যাওয়ার পর বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপন নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার করে পশ্চিমা দুনিয়ায় আলোড়ন তুলেছিল এবিসি নিউজ।
BD Human Rights

জিম ইয়ার্ডলির লেখা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আশুলিয়া থেকে এক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত হিজলহাটি গ্রামে বাস করতেন আমিনুল। তার বিধবা স্ত্রী হোসনে আরা বেগম ফাহিমা এখনও সেখানে ইটের তৈরি সেই বাড়িতেই বাস করেন। আমিনুলকে ফের সেখানে দাফন করা হয়েছে। বেকার ফাহিমা (৩২) তার সন্তানদের ভবিষ্যত্ নিয়ে উদ্বিগ্ন। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার টেলিফোন কলের দুঃস্বপ্ন এখনও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তিনি জানেন না, কে আমিনুলকে হত্যা করেছে। তবে যে রাতে আমিনুল নিখোঁজ হন, সে রাতে তিনি একটি দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠেন। স্বপ্নে তিনি দেখতে পান, তার স্বামী কাঁদছে। আমিনুলের চারপাশ ঘিরে রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী।
নিউইয়র্ক টাইমসে ‘ফাইটিং ফর বাংলাদেশ লেবার, অ্যান্ড এন্ডিং আপ ইন পপার’স গ্রেভ (বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলনের পরিণতি বেওয়ারিশ লাশে পরিণত হওয়া)’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, হত্যার আগে অমিনুলের ফোনে আড়িপাতা হতো। পেশাদার বাহিনী বর্বর নির্যাতন করে আমিনুলকে হত্যা করেছে। আমিনুল হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে বড় রহস্য এনএসআই এজেন্ট মোস্তাফিজ রহমান। আমিনুল হত্যাকাণ্ডের পর তাকে আর দেখা যায়নি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের পোশাক খাত নিয়ে গত ২৪ আগস্ট ‘এক্সপোর্ট পাওয়ার হাউস ফিলস প্যাঙস অব লেবার স্ট্রাইফ’ শিরোনামে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রিন্ট সংস্করণে আরও একটি প্রধান প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়, যা সে সময় ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে।

নিউইয়র্ক টাইমসের পূূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন : 

জবুথবু অনেক পোশাক কারখানার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল আমিনুলের কার্যালয়। এসব পোশাক কারখানা গ্যাপ ও টমি হিলফিগারের মতো ব্র্যান্ডের জন্য কার্গো প্যান্ট অথবা পোলো শার্ট তৈরি করে থাকে। তবে শ্রমিকরা আমিনুল ইসলামকে ঠিকই খুঁজে নিয়েছিলেন। তারা তার কাছে ছুটে আসতেন বহু সমস্যা নিয়ে; অনিয়মিত বেতন, নিপীড়ক মনিব (বস)। শ্রমিক সংগঠক আমিনুল তাদের অধিকারের জন্য লড়াই করতেন।
নিরাপত্তা বাহিনীগুলোও আমিনুলকে খুঁজে বের করেছিল। তার ফোনে আড়িপাতা হতো। পুলিশ নিয়মিত তাকে হেনস্তা করত। তার সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যরা জানান, একবার অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা তাকে অপহরণ করে বেদম প্রহার করে। আমিনুলকে একাধিকবার বলা হয়েছে যে তার আন্দোলন দেশের ক্ষতি করছে। এ দেশে পোশাক রফতানি অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির চালিকাশক্তি। এরপর আমিনুলকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
গত ৪ এপ্রিল তিনি নিখোঁজ হন। এর কয়েকদিন পর তার পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন নির্যাতন করে তাকে হত্যা করা হয়েছে। তার হত্যাকাণ্ড দেশটির ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নির্মম হত্যাকাণ্ডের উত্তরাধিকার রয়েছে। ফলে এ প্রশ্ন উঠেছে : শ্রমিকদের সংগঠিত করার কারণেই কি তাকে হত্যা করা হয়েছে?


হত্যাকাণ্ডের ৫ মাস পরেও এখনও বিষয়টি তদন্তাধীন। এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। পুলিশ বলছে, এ মামলায় অগ্রগতি নেই বললেই চলে। যেদিন আমিনুল নিখোঁজ হন, সেদিন তিনি কয়েকটি গার্মেন্টের অচলাবস্থা ভাঙার চেষ্টা করছিলেন। ওই কারখানাগুলো টমি হিলফিগার, আমেরিকান ঈগল ও বিশ্বখ্যাত অন্যান্য ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক তৈরি করে। এ সময় রোরখা পরা এক নারীকে সঙ্গে নিয়ে আমিনুলের কাছে অপ্রত্যাশিতভাবে একজন পরিচিত লোক আসেন। তিনি এসেই আমিনুলকে বলেন, তাকে জরুরিভিত্তিতে তার বিয়েতে যেতে হবে। ওই লোকটির সঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থার সম্পর্ক রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এরপর আমিনুল তার বিয়েতে সহায়তা করার জন্য একটি রিকশায় চেপে বসেন। কিন্তু তিনি আর ফিরে আসেননি।


শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য আন্দোলনের কারণে আমিনুল বাংলাদেশের ক্ষমতাধরদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। চীনের পরই পোশাক রফতানিতে এখন বিশ্বে অবস্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পোশাক রফতানির অত্যাবশ্যকীয় ফরমুলা হলো সস্তা ও অসংগঠিত শ্রম। এখানে একজন গার্মেন্ট শ্রমিক মাসে বেতন পান ৩৭ মার্কিন ডলার (মাত্র তিন হাজার টাকা)। পোশাক কারখানাগুলোয় শ্রমিক ইউনিয়নের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।


প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বহির্বিশ্বের নজরে খুব কমই পড়ে। কিন্তু আমিনুল হত্যাকাণ্ড নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে তোলপাড় শুরু হয় এবং এ ঘটনার নিন্দা জানান, ইউরোপ ও আমেরিকার কূটনীতিবিদরা। এমনকি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এর প্রধান কারণ আমিনুল এএফএল-সিআইও নামে একটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের স্থানীয় নেতা ছিলেন। বাইরের চাপের আংশিক কারণ হলো এখন অনেক ব্র্যান্ড বাংলাদেশের পোশাক আমদানি করে থাকে। আমেরিকার শ্রমিক আন্দোলনকারী সংগঠন এএফএল-সিআইওর সঙ্গে জড়িত ছিলেন আমিনুলের স্থানীয় সংগঠনটি। ওই সংগঠনটিই একে ভূরাজনৈতিক রূপ দিয়েছে।


বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশ সরকার ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবিশ্বাস বিরাজ করছে। আমিনুল হত্যাকাণ্ডসহ শ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে বাংলাদেশকে দেয়া বাণিজ্য সুবিধা বাতিল করে দিতে ওয়াশিংটনের প্রতি আবেদন করছে এএফএল-সিআইও। এএফএল-সিআইওর এলোঞ্জো সুসন বলেন, ভাবখানা এমন যে তোমরা দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করছ কেন। এএফএল-সিআইওকে দেশদ্রোহী হিসেবে মনে করা হয়।


আমিনুলের কর্মকাণ্ডের কারণে তাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়। ২০১০ সালে গার্মেন্টে তীব্র আন্দোলন শুরু হলে আমিনুল ও তার দুজন বসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী তত্পরতার অভিযোগ আনা হয়। এ সময় আমিনুল ও তার বসদের বিরুদ্ধে পুলিশি ও গোয়েন্দা সংস্থার নিপীড়ন এত তীব্র আকার ধারণ করে যে, তারা একটি চুক্তিতে উপনীত হতে বাধ্য হন। আমিনুলের সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সের (এনএসআই) পরিচালকের মধ্যে একটি গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সরকারের কর্মকর্তারা অভিযোগ অস্বীকার করলেও আমিনুুলের সহকর্মী কল্পনা আকতার প্রশ্ন করেন, কারা এত ক্ষমতাধর যে আমিনুলকে হত্যার পরও তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।


শ্রমিকদের কণ্ঠস্বর : আমিনুল ইসলাম ছিলেন একজন খাটো মানুষ। বড়জোর ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি লম্বা। তবে তিনি ছিলেন দৃঢ়মনা। শ্মশ্রূমণ্ডিত এই লোকটি ছিলেন খুব ধর্মপরায়ণ। গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি ৪০ দিনের চিল্লায় গিয়ে লোকদের আরও ভালো মুসলমান হওয়ার জন্য উত্সাহিত করেছেন। মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে শ্রমিকদের সংগঠিত করে তিনি শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত হন। শাশা গার্মেন্টে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। ২০১০ সালে শ্রমিকদের আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন সরকার বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নিবন্ধন বাতিল করে দেয়। ওই সংগঠনের হয়ে কাজ করতেন আমিনুল। তার মনিব কল্পনা আকতার ও বাবুল আকতারকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে তারা শ্রমিকদের উসকানি দিচ্ছিলেন। তারা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আমিনুলের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ আনা হয়।


তবে সবচেয়ে উদ্ধ্যত ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা ঘটে সে বছরের জুন মাসে। আমিনুলকে অপহরণ করে এনএসআইয়ের এজেন্টের নেতৃত্বে ঠকদের একটি দল। আমিনুল জানিয়েছেন, তাকে ঢাকার উত্তরে নিয়ে গিয়ে বেদম প্রহার করা হয়। এজেন্টরা আমিনুলকে গার্মেন্ট আন্দোলন ত্যাগ করার জন্য একটি কাগজে স্বাক্ষর করতে বলেন। অন্যথায় তাকে এবং তার পরিবারকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। তবে সেবার পালিয়ে আসতে সক্ষম হন আমিনুল।


আমিনুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন, এমন একজন শ্রমিক নেত্রী লাবণী আকতার বলেন, ‘নির্যাতনের সময় তারা আমিনুলকে বলেছে—তুই শ্রমিকদের নেতা হতে চাস। আমরা তোকে অনুসরণ করছি। আমরা তোর ফোনে আড়ি পাতি।’


গোপন চুক্তি : ২০১০ সালের দাঙ্গার পর শ্রমিকরা আংশিক বিজয় লাভ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রমিকদের ন্যূনতম মাসিক বেতন ৩৭ মার্কিন ডলারে উন্নীত করেন। অনেক শ্রমিক বিশ্বাস করতেন, এর পরের আন্দোলন হবে শ্রমিক সংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার পদক্ষেপ নেয়া। শ্রমিকদের আশা ছিল, বিবাদ নিরসনের জন্য স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ পন্থা অবলম্বন করা হলে শ্রমিকদের রাস্তায় আন্দোলন করতে হবে না।


তবে বাংলাদেশ সরকার এর পরিবর্তে নজরদারি বাড়িয়ে দেয়। ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেল’ নামে সরকারের একটি বিশেষ কমিটি এখন গার্মেন্ট খাত তদারকি করে থাকে। শিল্প পুলিশ নামে নতুন একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তৈরি করা হয়েছে। তারা গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে এবং শিল্প এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষ সম্পর্কে আগাম তথ্য দেয়।


কল্পনা আকতার বলেন, সেই নির্যাতনের পর আমিনুল কিছুটা আড়ালে চলে যান। তবে এনএসআইয়ের এজেন্টরা প্রায়ই আমিনুলের সঙ্গে সাক্ষাত্ করত। এ অবস্থায় কল্পনা আকতার আমিনুলকে জিজ্ঞেস করেন তিনি শ্রমিক আন্দোলন ছেড়ে দিতে চান কি না। আমিনুল বলেন, ‘না, আমি কাজ করতে চাই। এটা আমার গভীর আবেগের বিষয়।’


এরপর ২০১০ সালের শেষ দিকে আমিনুল ও এনএসআইয়ের পরিচালকের মধ্যে একটি গোপন বৈঠক হয়। ওই বৈঠক সম্পর্কে অবগত অন্তত তিনজন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এনএসআই পরিচালক আমিনুলকে তার মোবাইল নম্বর দিয়ে বলেন, কাজে সমস্যা হলে আমিনুল যেন তার মোবাইল ফোনে কল দেয়।
তবে আমিনুলের পরিবার ও সহকর্মীরা জানান, গত মার্চে আমিনুলকে ডজনখানে কর্মকর্তা তুলে নিয়ে যায়। শিল্প পুলিশ একটি অসত্য গুজব সম্পর্কে তাকে প্রশ্ন করেন, তিনি নাকি ১২ মার্চ বিএনপির একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ১০ হাজার লোক সরবরাহ করবেন। আমিনুল এ কথা অস্বীকার করেন। তখন আমিনুলকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু বলা হয়, সমাবেশের দিন তিনি যেন আবার এসে দেখা করেন।


ঠিক সে সময়ই আশুলিয়ার শান্তা ডেনিম কারখানায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। যদিও বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা দেখতে না দেয়ার কারণে আন্দোলন শুরু হয়; তবে সহসাই তা বেতন বৃদ্ধি, যৌন নির্যাতন, নারী শ্রমিকদের নিপীড়ন ও অন্যান্য ইস্যুর সঙ্গে জড়িয়ে যায়।


শ্রমিকরা আমিনুলের সাহায্য চান। আমিনুল সরকারের উচ্চপর্যায়ের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে ফোনে কথাবার্তা বলছিলেন। আমিনুলের মধ্যস্থতায় ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় একটি সমঝোতা হয় যে, পরদিন শ্রমিকরা কাজে যোগদান করবেন। এরপর নিখোঁজ হন আমিনুল।


কবর থেকে প্রমাণ : এর দু’দিন পর দৈনিক আমার দেশ-এ টাঙ্গাইলে পাওয়া একটি অজ্ঞাত লাশের ছবি ছাপা হয়। আমিনুলের গ্রামের একজন সেই ছবি দেখে আমিনুলের বাড়িতে পত্রিকাটি নিয়ে যান। আমিনুলের পরিবার যখন টাঙ্গাইলে পৌঁছে, তার আগেই বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে আমিনুলকে দাফন করে পুলিশ। পুলিশের তোলা লাশের ছবিতে দেখা যায়, আমিনুলের হাঁটু গুঁড়ো করে দেয়া হয়েছে এবং তার পায়ের তলা ভেঙে ফেলা হয়েছে। তার ডান হাঁটুর নিচে ছিদ্র (ড্রিল) করা হয়েছে। চিকিত্সকরা বলেছেন, তাকে রক্তাক্ত করে হত্যা করা হয়েছে। পেশাদার গুন্ডারা এ ধরনের নির্যাতন করে থাকে।


১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলে আসছে। ২০০৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুুপের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্বরতা, দুর্নীতি ও অদক্ষতার জন্য কুখ্যাত বাংলাদেশের পুলিশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতাধরদের হয়ে প্রায়ই কাজ করে পুলিশ। নিজেদের লাভের জন্য সম্পদশালী ব্যবসায়ীদের পুলিশের সমর্থন কিনে নেয়ার ইতিহাস আছে। সময়মত বেতন না দেয়ায় শ্রমিকদের আন্দোলন দমনেও গার্মেন্ট মালিকরা পুলিশকে ঘুষ দিয়ে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে।


বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের মতে, ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২৯৭ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ২০০৯ সালে যখন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন, তখন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে চার বছর পেরিয়ে গেলেও এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। গত জানুয়ারি মাসে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, নিরাপত্তা বাহিনী আইনের ঊর্ধ্বে অবস্থান করছে। উপরন্তু গুমের মতো নতুন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে বলে মত দিয়েছে সংগঠনটি। অপহরণের পর অনেক লোকের আর হদিস মিলছে না। আমিনুলের সহকর্মীরা বিশ্বাস করেন তার ঘনাটিও একই রকমের। তবে নিরাপত্তা বাহিনীর জড়িত থাকার কথা সরকার অস্বীকার করছে।


আমিনুলের হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাইরের বিশ্বের উদ্বেগে গত জুলাইয়ে হতাশা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর জড়িত থাকার খবর অসত্য। আমিনুল গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা ছিলেন বলে যে খবর প্রকাশ করা হয়েছে, তা-ও বিভ্রান্তিকর। তিনি বলেন, আপনারা পশ্চিমা দেশগুলোর দূতাবাসকে কেন বলেন না যে, আমিনুল কোনো শ্রমিক নেতা ছিলেন না।


এই মামলায় সবচেয়ে বড় রহস্য মোস্তাফিজ রহমানের সংশ্লিষ্টতা। আমিনুল যে রাতে গুম হন, সে রাতেই তার বিয়েতে আমিনুলের সাহায্য চেয়েছিলেন মোস্তাফিজ। আমিনুলের সহকর্মীরা বলছেন, নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল মোস্তাফিজের। নিউ এজ পত্রিকার অনুসন্ধানেও জানা গেছে, মোস্তাফিজ অন্য একজন শ্রমিক সংগঠককে গ্রেফতারে পুলিশকে সহায়তা করেছিল এবং নিরাপত্তা বাহিনীর এজেন্টদের সঙ্গে তাকে দেখা গেছে।


আমিনুল নিখোঁজের পর মোস্তাফিজকে আর দেখা যায়নি। আমিনুলের সমর্থকরা মনে করেন, সরকার জাতীয় ভাবমূর্তির জন্য আমিনুলকে হুমকি হিসেবে দেখত। একটি শ্রমিক ওয়েবসাইটে আমিনুল ২০১০ সালে তাকে অপহরণ ও নির্যাতনের কাহিনী প্রকাশ করেন। এ বছর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী টিভিস্টেশন এবিসি নিউজের একটি প্রতিবেদনে শ্রমিকদের সাক্ষাত্কারের ব্যবস্থা করে দেন। হামীম গ্রুপের একটি কারখানায় আগুন লেগে ২৯ জন শ্রমিক মারা যাওয়ার পর টিভিস্টেশনটি বাংলাদেশের গার্মেন্ট কারখানায় শ্রমিকদের অনিরাপদ কর্মপরিবেশ নিয়ে রিপোর্ট প্রচার করে।



আশুলিয়া থেকে একঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত হিজলহাটি গ্রামে বাস করতেন আমিনুল। তার বিধবা স্ত্রী হোসনে আরা বেগম ফাহিমা এখনও সেখানে ইটের তৈরি একটি বাড়িতে বাস করেন। আমিনুলকে ফের সেখানে দাফন করা হয়েছে। বেকার ফাহিমা (৩২) তার সন্তানদের ভবিষ্যত্ নিয়ে উদ্বিগ্ন। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার টেলিফোন কলের দুঃস্বপ্ন এখনও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তিনি জানেন না, কে আমিনুলকে হত্যা করেছে। তবে যে রাতে আমিনুল নিখোঁজ হন, সে রাতে তিনি একটি দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠেন। স্বপ্নে তিনি দেখতে পান, তার স্বামী কাঁদছে। আমিনুলের চারপাশ ঘিরে রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী।


------------------------------------------------

2) বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির (বিসিডব্লিউএস) সংগঠক শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামকে গত ৪ এপ্রিল (২০১২) আশুলিয়া থেকে অপহরণের পর হত্যা করে টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের পাশে লাশ ফেলে দেয়া হয়েছিল। ৫ এপ্রিল ঘাটাইল থানা পুলিশ ওই লাশ উদ্ধার করে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করে। ৬ এপ্রিল আমার দেশে প্রকাশিত অজ্ঞাত লাশের ছবির সূত্র ধরে আমিনুলের পরিবার তার লাশ শনাক্ত করে এবং ঘাটাইল থেকে লাশ তুলে এনে কালিয়াকৈরে আমিনুলের বাড়িতে দাফন করে। আমিনুল হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং প্রভাবশালী মহল জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।  ..... LINK  

No comments:

Post a Comment