Tuesday, April 28, 2015

বাংলাদেশে ভারতের যুদ্ধ ও ইসলামি জাগরণ

বাংলাদেশে ভারতের যুদ্ধ ও ইসলামি জাগরণ // ফি রো জ মা হ বু ব কা মা ল


শেষ হয়নি শত্রুর যুদ্ধ

শত্রুর যুদ্ধ কখনোই শেষ হয় না। শত্রু শুধু রণাঙ্গন ও কৌশল পাল্টায়। বাংলাদেশে ভারতের যুদ্ধ তাই শেষ হয়নি, তারা শুধু কৌশল পাল্টেছে।
যুদ্ধ দুটি ভিন্ন রূপে আসে। কখনও রক্তক্ষয়ী অস্ত্রযুদ্ধরূপে, কখনও স্নায়ুযুদ্ধ বা কোল্ডওয়াররূপে। অস্ত্রের যুদ্ধটি সীমান্তে হয়। আর স্নায়ুযুদ্ধ বা বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধটি হয় দেশের অভ্যন্তরে এবং ঘরে ঘরে ও রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে। আর সেটি অবিরামভাবে। এ যুদ্ধটি যেহেতু স্নায়ু বা চেতনার রাজ্যজুড়ে হয়, এ যুদ্ধকে তাই স্নায়ুযুদ্ধও বলা হয়। এ যুদ্ধে অস্ত্ররূপে কাজ করে বুদ্ধিবৃত্তি ও শিক্ষা-সংস্কৃতি; তাই এটি বুদ্ধিবৃত্তিক বা সাংস্কৃতিক যুদ্ধও। অস্ত্র ব্যবহৃত না হলেও এ যুদ্ধের নাশকতা কম নয়। বিগত একশ’ বছরে মুসলিম দেশগুলোর সবচেয়ে বড় পরাজয়গুলো হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তির যুদ্ধে এবং সে পরাজয়ের কারণে মুসলিম বিশ্বের ভৌগোলিক মানচিত্রের সঙ্গে পাল্টে গেছে চেতনা ও সংস্কৃতির মানচিত্রও। এ রণাঙ্গনে জিততে হলে যোদ্ধার বুদ্ধিবৃত্তিক বলটা অপরিহার্য।
স্নায়ুযুদ্ধে অস্ত্ররূপে কাজ করে ধ্যান-ধারণা, মতবাদ বা দর্শন। যুদ্ধ হয় শিক্ষা, সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি, মিডিয়া ও রাজনীতির ময়দানে। বিশ্বরাজনীতির ময়দান থেকে কমিউনিজমকে বিলুপ্ত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো মিত্রদের একটি তীরও ছুড়তে হয়। অপরদিকে মুসলমানরা তাদের আদর্শিক, রাজনৈতিক ও সামরিক বল হারিয়েছে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, কমিউনিজম, লিবারালিজম ও সেক্যুলারিজমের মতো মতবাদগুলোর হামলায়। সে হামলায় শক্তিহীন হয়েছে এবং অবশেষে ভেঙে গেছে উসমানিয়া খেলাফতের মতো দীর্ঘকালের বিশ্বশক্তি। মুসলমানরা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বলটি সর্বশেষ দেখিয়েছে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে। মাওলানা মহম্মদ আলী জওহার, আল্লামা কবি ইকবাল, কবি হালী, আশরাফ আলী থানবী, শিবলী নোমানী, সোলায়মান নদভীর মতো একঝাঁক মুসলিম জ্ঞানী ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। অবাঙালি মুসলমানদের সে বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ বাংলাতেই আঘাত হেনেছিল। পাকিস্তান অর্জিত হয়েছিল তো সে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়; কোন সামরিক শক্তি বলে নয়।
কিন্তু বাংলাদেশে ইসলামপন্থীরা সে যুদ্ধে পরাজিত হতে শুরু করে ১৯৪৭ সালের পর থেকেই। কারণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ইসলামপন্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক বলটি ছিল সামান্যই। অথচ ভারতের বিনিয়োগটি এক্ষেত্রে ছিল বিশাল ও পরিকল্পিত। বর্তমান স্নায়ুযুদ্ধ বা কোল্ডওয়ারটি মূলত ভারতের ১৯৪৭-পরবর্তী সে বিনিয়োগেরই ধারাবাহিকতা। এ যুদ্ধের মাধ্যমেই ভারত বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক মানচিত্রে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে। সে লক্ষ্য পুরণে সীমান্তে ভারত সৈন্য সমাবেশ না ঘটালেও দেশের অভ্যন্তরে লাখ লাখ সৈন্য দিবারাত্র নিয়োজিত রেখেছে। সে যুদ্ধেরই কৌশলরূপে ভারত বাংলাদেশে শুরু করেছে ডি-ইসলামাইজেশন প্রজেক্টবাংলাদেশ তার বর্তমান মানচিত্রটি ভাষা বা জলবায়ুর কারণে পায়নি। একই বাংলা ভাষা ও একই বাংলার জলবায়ু পার্শ্ববর্তী পশ্চিম বাংলার বহু কোটি বাঙালির জীবনেও আছে। পশ্চিম বাংলার জনসংখ্যার দশমাংশ জনসংখ্যা নিয়ে বিশ্বের প্রায় শতাধিক দেশ স্বাধীন আছে। কিন্তু তারা আলাদা স্বাধীন দেশ পায়নি। বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বের মূল ভিত্তিটি দেশটির ১৫ কোটি মানুষের আলাদা ধর্মীয় বিশ্বাস। সেটি ইসলাম। ভারত সে ভিত্তিটাই ধসিয়ে দিতে চায়। আর ভিত্তিতে ধস নামলে শুধু প্রাসাদই নয়, দেশও ধসে পড়ে। সে ধসাতেই বাংলাদেশে জোরেশোরে কোল্ডওয়ার বা স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছে। এ কোল্ডওয়ারের ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা হলো শত শত নাস্তিক ব্লগার। তারা ব্যবহার করছে ইন্টারনেটের মতো আধুনিক প্রযুক্তিকে। তারা যেমন ভারতে আছে, তেমনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও আছে। নাস্তিক ব্লগারদের সঙ্গে রয়েছে শত শত নাস্তিক মিডিয়াকর্মী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অঙ্গন, টিভি নেটওয়ার্ক, বহু এনজিও অফিস, বহু পত্র-পত্রিকার দফতর, এমনকি বহু সরকারি অফিস মূলত এসব ভারতপন্থীর হাতে অধিকৃত ভূমি। সেখান থেকে হামলা হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যান্য অঙ্গনে। হামলার লক্ষ্য শুধু ইসলামের মৌল বিশ্বাস, জিহাদি চেতনা ও কোরআন-হাদিসের শিক্ষা নয়; বরং খোদ মহান আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর প্রিয় নবী-রাসুল। তাদের সে বীভত্স প্রচারণা সম্প্রতি জনসম্মুখে প্রচারও পেয়েছে। তারা সে প্রচারণার মাধ্যমে লাখ লাখ বাংলাদেশীকে এরই মধ্যে মুরতাদ বানিয়ে ছেড়েছে। ইসলামে বিশ্বাসীদের রাজনীতিকেই শুধু নয়, তাদের শারীরিক উপস্থিতিও বাংলাদেশের মাটিতে তারা মেনে নিতে রাজি নয়।
একাত্তরের ভারত আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের বহু হাজার নেতাকর্মীকে নিজ দেশের অভ্যন্তরে নানা স্থানে নিয়ে দীর্ঘদিন ট্রেনিং দিয়েছিল। লক্ষ্য এই ছিল না যে, তাদের কাজ একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙার মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। শিক্ষা বা ট্রেনিংয়ের আছর কি নয় মাসে শেষ হয়? এমনকি কুকুর-বিড়ালের মতো ইতর জীবকে একবার পোষ মানানো হলে আজীবন তারা পোষ মানাই থেকে যায়। তারা বিদ্রোহ করে না। মানুষও তেমনি শিক্ষালয়ে যে শিক্ষা বা ট্রেনিং পায়, তা নিয়ে মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে এবং সে অনুযায়ী কাজ করে। শিক্ষার গুরুত্ব এত অধিক বলেই নামাজ-রোজা ফরজ করার আগে ইসলাম বিদ্যার্জনকে ফরজ করেছে। মিশনারিরা তাই মুসলিম দেশে এসে শত শত স্কুল-কলেজ খোলে এবং হাজার হাজার মেধাবী ছাত্রকে নিজ দেশে বৃত্তি দিয়ে নিয়ে যায়। তাই ভারতে গিয়ে যারা একবার রাজনৈতিক ও সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছে, তারা ভারতীয় গোলামির শিকলটি গলা থেকে নামিয়ে আবার স্বাধীনভাবে দাঁড়াবে, সেটি কি এতই সহজ? বাংলাদেশের স্বাধীনতার বড় শত্রু এ মানসিক গোলামরাই।
মানুষ যখন বিপদে পড়ে, তখন আপনজনের কোলে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কে কাকে কতটা আপন মনে করে, সেটি তখন বোঝা যায়। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও তাদের রাজনৈতিক মিত্ররা ভারতকে যে কতটা আপন মনে করে, সেটি কি শুধু একাত্তরে প্রকাশ পেয়েছে? সেটি যেমন ১৯৭৫ সালে দেখা গেছে, তেমনি আজও নানাভাবে বোঝা যাচ্ছে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে বাংলাদেশ আজ আর কোনো আলোচনার বিষয় নয়। পূর্ব পাকিস্তানকে তারা শুধু পাকিস্তানের মানচিত্র ও সংবিধান থেকেই বাদ দেয়নি, স্মৃতি থেকেও বাদ দিচ্ছে। সেদেশে এমন কোনো দল নেই, যারা বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানভুক্ত করার কথা মুখে আনে। তেমনি বাংলাদেশেও এমন কোনো রাজনৈতিক দল নেই, যারা পাকিস্তানের সঙ্গে আবার একীভূত হওয়া নিয়ে ভাবে। কিন্তু বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের যেমন প্রচুর ভাবনা আছে, তেমনি এজেন্ডাও আছে; এজেন্ডার সঙ্গে বিপুল বিনিয়োগও আছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করতে ভারতের বিনিয়োগ কত বিশাল ছিল, তার একটি বিবরণ দিয়েছে লন্ডনের বিখ্যাত পত্রিকা ‘দি ইকোনমিস্ট’। পাকিস্তান ভাঙাটিই আগ্রাসী ভারতের একমাত্র লক্ষ্য ছিল না; লক্ষ্য হলো, ভারতের পূর্ব সীমান্তে ইসলামি রাষ্ট্র গড়ে ওঠাকে যে কোনোভাবে প্রতিরোধ করা। কারণ আদর্শিক রাষ্ট্রের সীমারেখা কোনো ভৌগোলিক সীমানা দিয়ে সীমিত থাকে না। ভারতের ভয় সে আদর্শ ভারতে ঢুকে পড়া নিয়ে। দেশে দেশে ইসলামের বিপুল জাগরণ দেখে ভারতের সে ভয় আরও বহুগুণ বেড়েছে। ভারতের বিনিয়োগও বেড়েছে। তাই তাদের যুদ্ধটি স্রেফ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়; বরং সেটি ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের ভূমিতে ভারতের যুদ্ধটি তাই একাত্তরে শেষ হয়নি; বরং যতই বাড়ছে বাংলাদেশে ইসলামের জাগরণ ততই বাড়ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের বিনিয়োগ ও সংশ্লিষ্টতা।

বাংলাদেশে ভারতের যুদ্ধ

ভারতের শাসকচক্রের প্রচণ্ড ভয় দক্ষিণ এশিয়ার বুকে ইসলামি শক্তির উত্থান নিয়ে। তেমনি একটি উত্থান এসেছিল ১৯৪৭ সালে। সে মুসলিম উত্থানের মুলে ছিল ভাষা ও আঞ্চলিকতার ঊর্ধ্বে উঠে জন্ম নেয়া প্যান-ইসলামিক চেতনা। সে চেতনা নিয়েই ঢাকার বুকে ১৯০৬ সালে জন্ম নেয় মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগের নেতৃত্বে জন্ম নেয় পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে গেলেও চেতনা মারা পড়েনি। ফলে ভারতের যুদ্ধও শেষ হয়নি। কারণ চেতনা বেঁচে থাকলে সে চেতনার ভিত্তিতে দল গড়ে ওঠে, আন্দোলনও গড়ে ওঠে। তাই কোনো রাজনীতি বা আন্দোলন দমন করতে হলে চেতনাকে দমাতে হয়। কীরূপে সে ইসলামি চেতনাকে দমন করা যায়, সেটি ভারতীয়দের বিদেশনীতির আজও মূল স্ট্র্যাটেজি। এটা ঠিক যে, পাকিস্তানের ব্যর্থতা অনেক। ঘর বাঁধলে তাতে ভয়ঙ্কর শাপও বাসা বাঁধতে পারে। তা ডাকাতদেরও দখলে যেতে পারে। পাকিস্তান আজ অভ্যন্তরীণ শত্রুদের দখলদারির শিকার। কিন্তু তাতে ঘর বাঁধার গুরুত্ব কমে না। তাই পাকিস্তানের বর্তমান সঙ্কট দেখে যারা পাকিস্তানের সৃষ্টিকেই অহেতুক বলে, তাদের এ বিষয়টি বোঝা উচিত। তাছাড়া একটি শিশু প্রসবেও প্রচণ্ড বেদনা থাকে। আর ইসলামি বিপ্লব ও সভ্যতা প্রসবের বেদনা তো প্রকট ও দীর্ঘকালীন। তাতে বহু মানুষের জীবন ক্ষয় হয়, সম্পদহানিও হয়। সেটি নবীজি (সা.)-এর যুগেও হয়েছে। পাকিস্তান সে প্রসববেদনার মধ্যেই। বাংলাদেশও সে প্রসব বেদনায় প্রবেশ করতে যাচ্ছে। ১৯৪৭ সালের অখণ্ড পাকিস্তান বেঁচে থাকলে ইসলামি শক্তির উত্থান যে প্রবলতরভাবে হতো, সে বিষয়টিও ভারতীয় নেতাদের অজানা ছিল না। তাই শুরু থেকেই তারা পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিল। ১৯৪৭ সালের গান্ধী ও ইন্দিরা গান্ধীর বাবা জওহরলাল নেহরু পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা রুখতে ব্যর্থ হন। কারণ সে সময় ভারতীয় হিন্দুস্বার্থের জন্য কোনো সেবাদাস জোটেনি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দীন এবং শেরে বাংলা ফজলুল হকের মতো নেতারা তখন আগ্রাসী ভারতের হাতে শিকার ঘুঘুতে পরিণত হননি। তারা বরং অবাঙালি মুসলমানদের সঙ্গে মিলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় অংশ নেন। এতে ভারত অপেক্ষায় থাকে পরবর্তী সুযোগের এবং সেটি আসে ১৯৭১ সালে। ফলে সফল হয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটি কোমরভাঙা যুদ্ধ তৈরি করতে।
ইসলাম বিনাশের একটি গ্রান্ড স্ট্র্যাটেজিকে সামনে রেখেই ভারত ১৯৭২ সালে তাদের সশস্ত্র সৈনিকদের সরিয়ে নিলেও স্নায়ুযুদ্ধের কলমধারী যোদ্ধাদের তুলে নেয়নি; বরং বিপুলভাবে বাড়িয়েছে সে বাহিনীর জনবল। সেটির শুরু শেখ মুজিবের আমল থেকেই। তাই মুজিবকে ক্ষমতায় বসানোর পর দেশে কৃষি, শিল্প, রাস্তাঘাট ও আইনশৃঙ্খলায় কোনো উন্নয়ন ঘটেনি, কিন্তু প্রচণ্ডভাবে বৃদ্ধি ঘটেছে ছাত্র-শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া কর্মীদের ইসলাম থেকে দূরে সরানোর কাজ। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হয় ইসলামের শত্রু তৈরির বিশাল ইন্ডাস্ট্রিতে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা, মগজ ধোলাই করা ছাত্ররা যখন মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর মহান রাসুল (সা.)কে গালি দিয়ে ব্লগ লেখে, দাড়ি-টুপিধারী ব্যক্তিদের ফাঁসি চায়, ইসলামি রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে—তাতে কি বিস্ময়ের কিছু থাকে? বরং প্রমাণ মেলে ভারতের স্ট্র্যাটেজি ফল দিয়েছে। শাহবাগের মোড়ে বিগত আড়াই মাস ধরে তো সেসব ভারতীয় ফসলদেরই লাগাতার প্রদর্শনী চলছে। তারা শুধু জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করতে চায় না, নিষিদ্ধ করতে চায় সব ইসলামপন্থীদের রাজনীতি। রুখতে চায় আল্লাহর আইনের প্রতিষ্ঠা।

লক্ষ্য ইসলামের বিজয় রোধ

আওয়ামী লীগ বিগত সোয়া চার বছর ধরে ক্ষমতায়। এর আগে তারা আরও দু’বার ক্ষমতায় এসেছে। তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা তাই কোনো গোপন বিষয় নয়। ইসলামের বিজয় রোধ এবং যে কোনো মূল্যে আল্লাহর শরিয়তের প্রতিষ্ঠা রোধই তাদের রাজনীতি। সেটি তারা বার বার নানাভাবে প্রমাণ করেছে। তাছাড়া দলটির প্রতিষ্ঠাও ইসলামের খেদমতের জন্য হয়নি। বরং এ দলটির সব সামর্থ্য ব্যয় হয়েছে মুজিব বা হাসিনার মতো যারা ইসলামের অঙ্গিকারশূন্য তাদের ক্ষমতায় বসানোর কাজে। ইসলামের জাগরণ ঘটলে তাদের রাজনীতি যে ড্রেনে গিয়ে পড়বে সেটি তারা জানে। ফলে নিজেদের রাজনীতি বাঁচাতে তারা কোয়ালিশন গড়েছে দেশ-বিদেশের সব ইসলামবিরোধী শয়তানি শক্তির সঙ্গে। দিল্লির শাসকচক্রের সঙ্গে শেখ হাসিনার গভীর বন্ধুত্বের কারণ এ নয় যে, তাদের মিলটি ভাষা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাদ্য-পানীয়ে। বরং সে মিলটি তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডায়। রাজনৈতিক সম্প্রীতি তো গড়ে ওঠে এরূপ অভিন্ন এজেন্ডার ওপর ভিত্তি করে। এজন্যই ভারতীয় শাসককে মুজিব বা হাসিনার মতো বাঙালি হওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। ইন্দিরা ছিলেন এলাহাবাদের উর্দুভাষী মহিলা। কিন্তু তারপরও মুজিবের সঙ্গে তার প্রচণ্ড সখ্য জমেছিল। কারণ ইসলাম ও মুসলমানের স্বার্থহানি ঘটাতে উভয়ের রাজনৈতিক এজেন্ডায় ভীষণ মিল ছিল। কিন্তু সে মিলটি বাংলাদেশের কোনো ইসলামপন্থী দল বা কোনো আলেমের সঙ্গে না থাকায় মুজিব তাদের সঙ্গে একটি দিনের জন্যও একতা গড়তে পারেননি। ইন্দিরা গান্ধীর এজেন্ডা ছিল, ভারতের দু’পাশে বিস্তৃত বিশ্বের সর্ববৃহত্ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানকে খণ্ডিত করা এবং সুযোগ বুঝে খণ্ডিত দুর্বল বাংলাদেশকে ভারতভুক্ত করা। এটিই হলো ভারতীয় রাজনীতির বহুপরিচিত নেহরু ডকট্রিন। সে লক্ষ্যে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের জন্য যে কোনো ভারতীয় শাসকের মতো ইন্দিরা গান্ধীরও প্রস্তুতি ছিল। কারণ তিনি জানতেন, পাকিস্তান একদিন পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হবেই। তখন ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে মোতায়েন করা হবে পারমাণবিক বোমা বহনকারী দূর পাল্লার বহু ভারী মিসাইল। তখন ভারতের পক্ষে পদ্মা, সুরমা, কুশিয়ারা, তিস্তা, গোমতির পানি ডাকাতি করা সম্ভব হবে না। সম্ভব হবে না বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের বাজার দখল ও অর্থনৈতিক শোষণ। সেটি করতে গেলে অনিবার্য হযে উঠতো পারমাণবিক যুদ্ধ। তখন পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা হামলার মুখে পড়বে সমগ্র ভারত। সেরূপ একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির আগেই ভারত তাই পাকিস্তান খণ্ডিতকরণে উঠেপড়ে লাগে। সে যুদ্ধটি শুরুর জন্য তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুসলিম স্বার্থবিরোধী একজন ভারতভক্ত নেতার প্রয়োজন ছিল ইন্দিরার। সে ভূমিকা পালনে ১৯৭১-এ নিজেকে সঁপে দেন শেখ মুজিব।

মিত্র ইসলামের শত্রুর

ব্যক্তির আসল পরিচয় জানা যায় তার বন্ধুদের দেখে। কারণ প্রত্যেকেই চেতনা-চরিত্রের দিক দিয়ে অতি কাছের মানুষকেই বন্ধুরূপে বেছে নেয়। চোর-ডাকাত, ব্যভিচারী বা মদ্যপায়ীদের বন্ধুত্ব তাই কোনো ঈমানদারের সঙ্গে হয় না। ইসলামের শত্রুপক্ষও তাই কোনো আলেম-ওলামাকে দলে নেয় না। তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক মৈত্রী গড়ে না। ইসলামের শত্রুপক্ষের রাজনীতিতে তাই নাস্তিক কমিউনিস্ট, ভারতীয় পৌত্তলিক, আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ব্লগাররা আপনজন রূপে গৃহীত হয়। নাস্তিক ব্লগার রাজীব নিহত হওয়ার পর শেখ হাসিনা যেভাবে তার ঘরে ছুটে গিয়েছিলেন সেটি রক্তের টানে নয়। বরং একই আদর্শে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে। বাংলাদেশে শতাধিক ইসলাম প্রেমিক মানুষ নির্মমভাবে পুলিশের হাতে নিহত হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা কি তাদের বাসায় একবারও গিয়েছেন বা তাদের মৃত্যুতে একটিবারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন?
ইসলামের চিহ্নিত শত্রুদের সঙ্গে শেখ হাসিনা ও তার বাবার সহযোগিতাপূর্ণ নীতি কোনো গোপন বিষয় নয়। বর্তমানে ভারতে বসবাসরত চিত্তরঞ্জন সুতার হলো বাংলাদেশকে খণ্ডিত করে খুলনা ও বরিশাল বিভাগ এবং ঢাকা বিভাগের বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা নিয়ে স্বাধীন বঙ্গভূমি আন্দোলনের নেতা। ইসলাম ও মুসলমানদের সে ঘোরতর শত্রু। তেমনি মুসলিমবিরোধী চেতনা ছিল মনরঞ্জন ধরফনিভূষণ মজুমদারের। অথচ আওয়ামী লীগ এ তিনজনকেই তাদের দলের এমপি বানিয়েছিল। মনরঞ্জন ধর ও ফনিভূষণকে তো মন্ত্রীও বানিয়েছিল। মনরঞ্জন ধর ছিলেন এক সময় কংগ্রেসের নেতা। ১৯৪৭ সালে অবিভক্ত বাংলার সংসদে বাংলাকে বিভক্ত করে পশ্চিম বাংলাকে ভারতভুক্ত করার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। জ্যোতি বসুদের কারণেই কলকাতা পূর্ব পাকিস্তানে আসেনি। অথচ সেই জ্যোতি বসু শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শুধু তাই নয়, শেখ হাসিনা মন্ত্রী বানিয়েছেন ও কোলে টেনে নিয়েছেন বাংলাদেশের রাজনীতির অতি কট্টর নাস্তিক ও কম্যুনিস্টদের। সংসদে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, শাহবাগের যুবকদের থেকে তিনি অনুপ্রেরণা পান। নাস্তিক শাহবাগীদের সাহস জোগানোর জন্য সংসদ থেকে একটি প্রতিনিধি দলকেও সেখানে পাঠানো হয়। অথচ শাহবাগের মূল আয়োজক হলো সেসব ব্লগার যারা ইন্টারনেটে দীর্ঘকাল যাবত মহান আল্লাহতায়ালা, তাঁর মহান নবী (সা.) ও নবীজী (সা.)-এর স্ত্রী উম্মেহাতুল মু’মিনদের নিয়ে ইতর ভাষায় যা ইচ্ছে তাই লিখে আসছে। তাদের সে কুকর্ম জনসম্মুখে প্রকাশ পাওয়ায় বাংলার তৌহিদি মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়লেও শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ সে কুলাঙ্গারদের সমর্থন দেয়া বন্ধ করেনি। বরং গণধোলাই থেকে বাঁচাতে এসব শাহবাগি নাস্তিক ব্লগারকে দিন-রাত দেয়া হচ্ছে পুলিশি প্রটেকশন। শেখ হাসিনা তো নিহত ব্লগার রাজীবের বাসায় গিয়ে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার হুমকিও দিয়েছেন। রাজীবকে তথাকথিত দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদরূপে ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, নাস্তিক ব্লগারদের বক্তৃতাকে প্রায় সব টিভি চ্যানেলে লাগাতার দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ভারতের প্রতি নিমকহালালির রাজনীতি

আওয়ামী লীগের রাজনীতি মূলত ভারতের প্রতি নিমকহালালির রাজনীতি। ১৯৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর শেখ হাসিনা বহুদিন দিল্লিতে কাটান। ভারতের নিমক তার পেটে তাই কম পড়েনি। আগের নির্বাচনগুলোর মতো বিগত নির্বাচনেও হাসিনা ভারত থেকে বিপুল অর্থ পেয়েছেন। আর অর্থের সঙ্গে তো শর্তও আসে। ফলে ক্ষমতায় আসার পরই তারা লিপ্ত হয় শর্ত পূরণে তথা ভারতীয় প্রভুর মনোবাসনা পূরণে। হাত দেয় জনগণের ঈমানে। ভারতীয় প্রজেক্টের অংশরূপেই শেখ মুজিব নাস্তিক কম্যুনিস্টদের দল গড়ার পূর্ণ আজাদি দিলেও সে আজাদি তিনি ইসলামপন্থীদের দেননি। বরং তিনি ইসলামপন্থীদের শত্রুরূপে চিহ্নিত করেছেন। সে নীতি নিয়েই চলেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু জনগণ এখন জেগে উঠেছে। জনগণের সে জাগ্রত রূপটি দেখা গেছে ৬ এপ্রিলের লংমার্চ ও সমাবেশে। দেখা গেল ১১ এপ্রিল ফটিকছড়িতে। ফটিকছড়ির জনগণ সেদিন হরতাল পালন করছিল। হরতালের মধ্য দিয়েই জনগণ জানিয়ে দেয় সরকারের বিরুদ্ধে তারা কতটা বিক্ষুব্ধ। এটি ছিল তাদের নাগরিক অধিকার। কিন্তু আওয়ামী লীগ জনগণকে সে অধিকার দিতে রাজি নয়। বিরোধী দলকে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে দেয়া দূরে থাক তাদের রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাতে দিতেও রাজি নয়। জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের তো তারা তাদের দলীয় অফিসে ঢুকতে দিচ্ছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ কমিশনার তো শিবির কর্মী দেখামাত্রই গুলির নির্দেশ দিয়েছেন। বিএনপি এবং জামায়াত-শিবিরের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাবন্দি করা হয়েছে। সেখানে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনও করছে। (চলবে) ...... Source LINK 

No comments:

Post a Comment