Wednesday, July 15, 2015

মুজিব বাহিনী :: মুক্তিযুদ্ধের রহস্যময় এক অকথিত অধ্যায়

Source LINK

মুজিব বাহিনী :: মুক্তিযুদ্ধের রহস্যময় এক অকথিত অধ্যায়


শাহাদত হোসেন বাচ্চু
আমাদের বুধবার - জুন ১৩, ২০১৫


একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ), যা মুজিব বাহিনী নামে সমধিক পরিচিত-আমাদের মুক্তিযুদ্ধে রহস্যময় এক অকথিত অধ্যায়। ইতিহাসের একটি বিশেষ সময়ে কেন, কি প্রেক্ষাপটে এই ‘গোপন’ বাহিনী গড়ে উঠেছিল, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কি আকারে প্রভাব বিস্তার করেছিল, প্রায় অর্ধশত বছর পরে এখনও অনেকটাই রহস্যময় এবং প্যান্ডোরার বাক্সে তালাচাবি দেয়া। মাঝে-মধ্যে গণমাধ্যম, জাতীয় সংসদসহ নানা টুকরো-টাকরা আলোচনায় এ নিয়ে বিতর্ক-উত্তেজনা সৃষ্টি হলেও এই বাহিনীর ভূমিকা জনগনের কাছে এখনও রহস্যাবৃত। অতি সম্প্রতি কিছু লেখা-জোখায় প্রসঙ্গটি উঠে আসতে শুরু করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতীয় প্রশ্রয়ে এ বাহিনী এতটাই ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছিল যে, মুজিবনগর সরকারকে তারা প্রকাশ্যে অবজ্ঞা ও অগ্রাহ্য করতে পেরেছিল।
ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠা মুজিব বাহিনীর ওপর সে সময়ে অস্থায়ী সরকারের কোন নিয়ন্ত্রন তো ছিলই না, বরং বিভিন্ন সময়ে এ বাহিনী সরকারের বিরুদ্ধে বৈরী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। মুজিব বাহিনীর প্রধান চার নেতা এবং সংগঠক ছিলেন সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। ভারতীয়রা এই নেতাদের আদর-স্নেহের সম্বোধন করতেন ‘অবিচ্ছেদ্য চার’ বলে। মুক্তিযুদ্ধের চার বছরের মাথায় শেখ মনি ১৫ আগষ্ট ট্রাজেডির শিকার হয়ে নিহত হন। রাজ্জাক মারা যান ২০১১ সালের ২৩ ডিসেম্বর। জীবিত দু’জনের মধ্যে তোফায়েল আহমেদ বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও নীতি নির্ধারক। অপরজন বাংলাদেশের রাজনীতির কথিত ‘রহস্য পুরুষ’ সিরাজুল আলম খান এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়।
জীবিত বা মৃত এই চার নেতার কেউই মুজিব বাহিনীর জন্ম ও কার্যক্রম নিয়ে ক্ষৃদ্রায়তন সাক্ষাতকার ছাড়া কোথাও কিছু বলেনওনি, লেখেনওনি। তবে সিরাজুল আলম খানের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে (www.serajulalamkhan.00.uk/person.htm) তাকে মুজিব বাহিনীর পূর্বতন কাঠামো স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের প্রতিষ্ঠাতা ও ‘বাংলাদেশের স্থপতি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সেনা কমান্ডোর আদলে গড়ে ওঠা র‌্যাডিক্যাল এই বাহিনীর সামগ্রিক দায়িত্বে ছিলেন একজন গেরিলা যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ শিখ সেনা কমান্ডার মেজর জেনারেল এস এস উবান সিং। কার্যত: তিনি ছিলেন এ বাহিনীর প্রশিক্ষক ও সর্বাধিনায়ক। তার লেখা ফ্যানটম অব চিটাগাং: ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ গ্রন্থে মুজিব বাহিনীর গড়ে ওঠা এবং এর সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। কেন বইয়ের শিরোনামে তিনি মুজিব বাহিনীকে ফিফথ আর্মি নামে উল্লেখ করেছেন, সেটি গভীর রহস্য ও বিষ্ময়ের বিষয়। কারন যুদ্ধের ইতিহাস বা ব্যবহারিক পরিমন্ডলে ফিফথ আর্মি শব্দদ্বয় দিয়ে সাধারন সেই ধারার ট্রেইটরদের বোঝানো হয় যারা নিজ রাষ্ট্রের বিপক্ষে বা রাষ্ট্রের শত্রুদের স্বার্থানুকূলে ভূমিকা রাখে।
প্রয়াত জাসদ নেতা ও মুজিব বাহিনীর সংগঠকদের একজন কাজী আরেফ আহমেদ লিখেছিলেন, পুর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৬২ সাল থেকে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগে গোপন একটি নিউক্লিয়াস কাজ করত।এই নিউক্লিয়াসের অপর সদস্যদ্বয় ছিলেন আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ নিজে। পরে অনেকে অন্তর্ভূক্ত হন। ঐ গোপন রাজনৈতিক নিউক্লিয়াসের পরিবর্ধিত সংস্করণ হচ্ছে বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী, ১৯৬৫ সাল থেকে আবদুর রাজ্জাক যোগাযোগ রাখতেন শেখ মুজিবের সাথে (জনকন্ঠ ২৮ ও ২৯ মার্চ ১৯৯৫)। মুজিব বাহিনী বা বিএলএফ গঠিত হয়েছে ২৫ মার্চের আগে। কাজী আরেফের লেখায় স্পষ্ট না থাকলেও নানা উৎস ও সূত্রের দাবি, “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ” সশস্ত্র শাখা গঠন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)। প্রতি রাতে হল সংলগ্ন মাঠে ডামি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ হতো। এর অর্থ দাঁড়ায়, একাত্তরের অনেক আগেই স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ ছাত্রদের মাঝে সশস্ত্র কার্যক্রমের সূচনা ঘটিয়েছিল। দেশের অনেক জেলা ও মহকুমা সদরে ২৫ মার্র্চের আগেই এরকম প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রাগার লুন্ঠনের ঘটনা জানা যায়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনীতির ইতিহাসে আকরতূল্য গ্রন্থ হিসেবে যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মইদুল হাসানের ‘মূলধারা ৭১’ খুবই উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেন, একাত্তরের ১৮ এপ্রিল নবগঠিত অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রীসভা দেশের ভেতর থেকে ছাত্র-যুব কর্মী সংগ্রহের দায়িত্ব দেয় শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের ওপর। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অজ্ঞাত কারণে চার যুবনেতাকে আরো ক্ষমতা প্রদান করেণ। রিক্রুটিং ছাড়াও সশস্ত্র বাহিনী গঠন ও পরিচালনার অধিকার দেয়া হয় তাদের। অতিরিক্ত এই ক্ষমতা প্রদানে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের অসম্মতি ও সর্বাধিনায়ক ওসমানীর সংশয় পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম তাঁর লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে গ্রন্থে লিখেছেন, “জুন মাস থেকে দেখা গেল বিভিন্ন শিবির থেকে প্রশিক্ষণের জন্য অপেক্ষারত তরুণরা নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। এই যুবকদের গোপনে অন্য ধরণের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা এতই সুপরিকল্পিত ও বিস্তৃত ছিল যে, বিশেষ বিমানে কঠোর নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার মাধ্যমে সেটা হত। ফলে ভাবতে বাধ্য হলাম, আমদের বিশ্বাস করা হচ্ছে না। সেক্টর কমান্ডাররা সবাই এতে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেণ। জানিয়ে দেয়া হল এ ব্যাপারে নাক গলাবেন না। পরে জানতে পেরেছিলাম ‘র’ ছিল এর মূল উদ্যোক্তা। …. রাজনৈতিক দিক থেকে এটা ছিল এক সর্বনাশা সিদ্ধান্ত। এ ধরণের গোপন পরিকল্পনার কারণে যুদ্ধের সময়ই মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। আমরা জানতে পেরেছিলাম, সুদুরপ্রসারী রাজনৈতিক বিবেচনায় এই পরিকল্পনাটি গ্রহন করা হয়েছিল। এ ধরণের কর্মকান্ডে বাংলাদেশ সরকারের কোন অনুমোদন ছিল না। তাদের যেসব মিশনে পাঠান হত তার কিছুই আমরা জানতাম না। এই বিশেষ বাহিনী সে সময়ে মুক্তিযুদ্ধে কোন বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নি। এরা ভিন্ন ধরণের রাজনৈতিক তৎপরতায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রথম থেকেই। ‘র’ এই পরিকল্পনার মাধ্যমে অদৃশ্য ও কাল্পনিক কোন এক শক্তির বিরুদ্ধে নতুন এক ফ্রন্ট খোলে…”। রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম যাকে অদৃশ্য ও কাল্পনিক কোন এক শক্তি বলছেন তা আসলেই অদৃশ্য বা কল্পনাপ্রসূত ছিল না। এই নতুন ফ্রন্ট খোলার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য অচিরেই পরিস্কার হয়ে উঠবে।
মইদুল হাসান আরো লিখেছেন, ‘মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রথম ব্যাচটির আত্মপ্রকাশের সাথে সাথে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এ বাহিনী পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী তথা বাংলাদেশ সরকারের কোন এখতিয়ার নেই। কেবল প্রশিক্ষণ নয়, যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র ও রসদের যোগান আসত ভারতীয় গেয়েন্দা সংস্থা’র-এর বিশেষ উপসংস্থা স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স থেকে এবং এর প্রধান জেনারেল উবান ছিলেন মুজিব বাহিনী গড়ে তোলার দায়িত্বে। মুজিব বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘মূলধারা ৭১’ গ্রন্থে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী যে অভিযোগ এনেছেন, পরবর্তীকালে তার কোন অনুসন্ধান বা তদন্ত দুরে থাক, এমনকি আমলেও নেয়া হয়নি। মইদুল অভিযোগগুলি জানাচ্ছেনঃ
এক. মুজিব বাহিনী স্বাধীন সংগ্রামকে বিভক্ত করেছিল;
দুই. বামপন্থীদের বিরুদ্ধাচরণ করা; (বামপন্থী কর্মী নিধন, কোথাও কোথাও সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া; উদাহরণ: ডিসেম্বরের শেষে পানিঘাট এলাকায় ভৈরব নদীতে ভারতীয় সেনা বাহিনী ও মুজিব বাহিনীর সাথে কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটির গেরিলাদের সংঘটিত যুদ্ধ। -লেখক)
তিন. সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র কেড়ে নেয়া;
চার. মুক্তিবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে অবতীর্ণ হওযা:
পাঁচ. মুজিবনগর সরকারের প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচরণ; এবং
ছয়. যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণা ও তাঁর প্রাণনাশের অভিযোগ।
মইদুল হাসান লিখেছেন, মুজিব বাহিনীকে স¦তন্ত্র কমান্ডে রাখার বিষয়ে ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল খুবই জোরাল। তাজউদ্দিনের তরফে মুজিব বাহিনী সৃষ্ট বিড়ম্বনা বন্ধে খোদ ইন্দিরা গান্ধীকে ভূমিকা রাখার অনুরোধও উপেক্ষিত হয়েছিল।
মুজিব বাহিনীর বিষয়ে মইদুল হাসানের এই লেখনীর সমর্থন পাওয়া যাবে এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার, এম আর আকতার মুকুল, ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম, কাজী জাফর আহমেদ, রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম, মনি সিং প্রমুখের লেখনীতে। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে এদের লেখনী সম্পুর্ণরূপে প্রাণিধানযোগ্য। যদিও ভিন্ন আদর্শতাড়িত হওয়ায় এসব বর্ণনা ব্যক্তিগত আবেগ ও এবং রাজনীতির উর্ধ্বে নয়। এটি ধরে নিলেও জেনারেল উবানের গ্রন্থ ও অন্যান্যদের লেখনী, বক্তব্য এবং আলোচনার ভিত্তিতে সাধারণ ধারণাটি মূর্ত হয়ে ওঠে যে, মুজিব বাহিনীর গঠন ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। ভারতের সংস্থা ‘র’-এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে গঠিত ও বিকশিত এবং যুদ্ধকালীন বৈরীতা ও আনুগত্যহীনতার বিষয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় রহস্যময় ও প্রায় এক অনালোচিত অধ্যায়।
এই স্বল্প পরিসরের লেখায় মুজিব বাহিনীর সৃষ্টি ও বিকাশের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে, যা একটি উপক্রমনিকা মাত্র। যে কোন যুদ্ধেই চেইন অব কমান্ড অপরিহার্য। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী সরকারই ছিল বৈধ ক্ষমতার একমাত্র কেন্দ্র। কিন্তু এই সরকারের প্রতি মুজিব বাহিনীর আনুগত্যহীনতা ছিল প্রকাশ্য। জেনারেল উবান তার গ্রন্থে লিখেছেন, ‘তাজউদ্দিনের প্রতি চার যুবনেতার কোন আনুগত্য ছিল না এবং যুদ্ধের পরেও তা অব্যাহত থাকে’। এই বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় প্রখ্যাত সাংবাদিক এনায়েতুল্লাহ খান ইংরেজী সাপ্তাহিক হলিডেতে এই বাহিনীকে বর্ণনা করেছিলেন Super Autonomous হিসেবে। তাঁর মতে মুজিব বাহিনী সৃষ্টির কারন ছিল; “স্বাধীনতা যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধে রূপ নেয়ার সম্ভাবনা ছিল। সেক্ষেত্রে লিবারেশন আর্মির ধাঁচে কিছু গড়ে উঠলে মোকাবেলার জন্য, বিশেষত: ঐ রূপ যুদ্ধে র‌্যাডিক্যাল সামাজিক শক্তির বিপরীতে ভারসাম্য রাখতে মুজিব বাহিনীর সৃষ্টি করা হয়। এর অন্য লক্ষ্য ছিল, পাকিস্তানে আটকাবস্থা থেকে শেখ মুজিব ফিরে না এলে এমন একটি শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য তৈরী রাখা, যারা সরাসরি মুজিবের উত্তরাধিকার দাবি করতে পারে। এই অন্য লক্ষ্যকে কেন্দ্র করেই মূলত: প্রবাসী সরকারের সাথে চার যুবনেতার সৃষ্ট দ্বন্দ্ব ও বিরোধ, যা আর কখনই মীমাংসিত হয়নি’’।
জেনারেল উবান ও সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু গ্রন্থের বিবরনে দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় কমিউনিষ্ট বিরোধী এবং বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জাতিগোষ্ঠির মুক্তিসংগ্রাম বিরোধী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আন্ত:দেশীয় ঘটনাবলীর সাথে মুজিব বাহিনীর উত্থান পর্ব জড়িয়ে গিয়েছিল। এই নিবন্ধে সেটি আলোচনার বিষয় নয়। মূলত: মুক্তিযুদ্ধকালে কোলকাতায় এই বাহিনীর কার্যক্রম এবং এর ফলে প্রবাসী সরকারে সৃষ্ট ঘাত-অভিঘাত ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। অচিরেই দেখা যাবে, বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আওয়ামী নেতৃত্ব যুদ্ধকালে উপদলীয় কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছিলেন, যার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক বিপর্যয় মোকাবেলায় সরকার ঝুঁকিতে ছিলেন সর্বদা। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদের জীবননাশের আশংকা তৈরী করেছিল এই কোন্দল।
যুদ্ধকালে সরকার প্রধান এবং সামরিক প্রধানের প্রতি উপেক্ষা ও আনুগত্যহীনতা চরম বিরোধিতাতুল্য হলেও মুজিব বাহিনী সংগঠকদের এজন্য কখনই জবাবদিহি করতে হয়নি। তারা প্রকাশ্যেই বলছিলেন, শেখ মুজিবের নির্দেশ ছিল, তাঁর অনুপস্থিতিতে চার যুবনেতা সামরিক কাঠামোর নেতৃত্ব দেবেন এবং তাজউদ্দিন রাজনৈতিক কাঠামোর নেতৃত্ব দেবেন। ২৫ মার্চ কালরাতে শেখ মুজিবের গ্রেফতারের পরে তাজউদ্দিন আহমেদ গঠিত প্রবাসী সরকারের প্রধান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সামরিক কাঠামো মুক্তিবাহিনী গঠনে উদ্যোগী হলে চার যুবনেতা, বিশেষভাবে শেখ ফজলুল হক মনি তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। এমনকি সরকার গঠন ও তাজউদ্দিনের প্রধানমন্ত্রী হওয়াকে ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালে চার যুবনেতার রাজনৈতিক উচ্চাশা অস্পষ্ট ছিল না। শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে তাঁরা আশা করছিলেন যে, সামগ্রিক নেতৃত্ব তাদের হাতেই থাকবে। বিশেষ করে শেখ মুজিবের ভাগ্নে হিসেবে শেখ ফজলুল হক মনি নেতৃত্বের উত্তরাধিকার দাবি করেন। শেখ মনি দাবি করতে থাকেন, তিনিই উত্তরাধিকারী এবং তার অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য একচ্ছত্র ক্ষমতা শেখ মুজিব তাকে দিয়ে গেছেন। জেনারেল উবান জানাচ্ছেন, “তাজউদ্দিনের প্রতি এই যুবনেতারা প্রচারনা চালাতেন যে, তিনি জবরদখলের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন”। স্বাধীনতার পরেও এই মনোভাব অব্যাহত থাকে। এমনকি ১৯৮৯ সালের জুনে সাংবাদিক মাসুদুল হককে দেয়া এক সাক্ষাতকারে আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, “তাজউদ্দিন নিজেই নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, আমরা বুঝলাম এটা ষড়যন্ত্র। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদেশ পালন করলেন না। আমরা এটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারলাম না”।
স্বাধীনতার ১৮ বছর পরে দেয়া এ সাক্ষাতকার থেকে পরিস্কার হয়ে ওঠে যুদ্ধকালে চার যুবনেতার তীব্র ক্ষোভের ব্যপ্ততা। মূলধারা ৭১ গ্রন্থে যেমনটি দাবি করেছেন মঈদুল হাসান, মুজিব বাহিনীর প্রধান চার নেতার অন্তত: দু’জন সে সময়ে তাজউদ্দিন আহমেদকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব ফারুক আজিজ খানের লেখায় মঈদুলের দাবির সমর্থন মেলে । ফারুক তার গ্রন্থে লিখেছেন, In October, he (D.P. Dhar) cautioned the Prime Minister (Tazuddin Ahmed) about the strong opposition that developed within the AL against him. When the meeting was going on (between the two) in BSF office a telephone came and I was informed that an young man was detained by the BSF guardes with a hand grenade and some explosive in his possession inside the 8 theatre road office compound…
সরকারের অভ্যন্তরে এমন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা সত্বেও রাজনৈতিক অবস্থান রক্ষা করতে সক্ষম হলেও মুজিব বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রন স্থাপন তো দুরের বিষয়, স্বতন্ত্রভাবে মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম পরিচালনাও প্রবাসী সরকারের পক্ষে কষ্টকর হয়ে ওঠে। আগষ্টে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ মুজিব বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রন প্রচেষ্টায় ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠকে মিলিত হন। এরপরেও অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটেনি। বরং মাঠ পর্যায়ে এই বাহিনীকে আরও সুবিধে করে দিতে ভারতে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড নির্দেশ জারি করে, “সীমান্তের ২০ মাইলের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম সীমিত থাকবে এবং অভ্যন্তরে যুদ্ধের দায়িত্ব মুজিব বাহিনীর”। এসময়ে এই বাহিনীকে ওয়ারলেস চ্যানেল ও কোড অব কমিউনিকেশনের সুবিধেও প্রদান করা হয়। আপাত: দৃষ্টিতে এই ব্যবস্থাকে একটি আপোষরফা মনে হলেও কার্যত: তা ছিল মুজিব বাহিনীর প্রতি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের পক্ষপাতদুষ্টতা এবং সরাসরি যুক্ত হওয়ার অনেক আগেই ভারতীয়রা কৌশলগত নিয়ন্ত্রন নিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু যে কোন পাঠকের কাছে বিষ্ময়কর হবে যে, অভ্যন্তরে কোন টেকসই রণনৈতিক প্রস্তুতি আমাদের জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব গ্রহন করেছিলেন কিনা? তবে ১৯৬২ থেকে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসনের সাথে বিবিধ যোগাযোগের একটি পটভূমি গড়ে উঠেছিল বলে জানা যায়। ফলে মুক্তিযুদ্ধ ভারতের নিজস্ব ইস্যুতে পরিনত করার প্রচেষ্টায় তারা সফল হয়েছিল। দীর্ঘ শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাগল মানুষের দুর্বার গণআন্দোলন যা পরিনত হয়েছিল বাঙালীর মুক্তিসংগ্রামের নিয়তি নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আর এই জন্যই ইতিহাসের নির্মোহ অবলোকন, আন্দোলনের প্রধান নেতা নিজ বাড়িতে গ্রেফতার বরণ করেন আস্থাভাজন চার যুবনেতাকে দিক নির্দেশনা প্রদান করে। সমকালীন ইতিহাস সম্ভবত: জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এরকম দৃষ্টান্ত আর দেখাতে পারবে না।
এ প্রসঙ্গে লিখেছেন ইতিহাসবিদ ড. আহমেদ কামাল ‘কালের কল্লোল’ গ্রন্থে। “একাত্তরের ২৫ মার্চ পূর্ববর্তী দুই সপ্তাহে পাক সেনাবাহিনীর আক্রমন প্রস্তুতি সম্পর্কে মুজিব নানা সূত্র থেকে খবর পাচ্ছিলেন। এরকম পরিস্থিতিতে করণীয় হিসেবে তিনটি বিকল্প ছিল তার জন্য; এক. জনযুদ্ধের নেতৃত্ব গ্রহন, দুই. ভারতে আশ্রয় নেয়া, তিন. পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার বরণ। প্রথম বিকল্প বেছে নেননি কারন আওয়ামী লীগের শ্রেনী অবস্থান সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। সে কারনেই ফিদেল ক্যাস্ত্রোর মত ভূমিকা এড়িয়ে গেছেন। দ্বিতীয় বিকল্প গ্রহন না করার মধ্য দিয়ে একদিকে পাক শাসক এলিটদের সাথে সমঝোতার ক্ষীণতম সম্ভাবনা জিইয়ে রেখেছিলেন এবং উপরন্তু, ভারতের শাসক এলিটদের সেই বাসনাকেও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছিল যার বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের মর্যাদা হতো অঙ্গরাজ্যতুল্য”।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে ঘিরে ভারত যে রাজনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিল ২৫ মার্চ শেখ মুজিবের গ্রেফতার সেটিকে অনিশ্চয়তায় নিক্ষেপ করে। এ প্রসঙ্গে ড. আহমেদ কামাল জানাচ্ছেন (প্রাগুক্ত), “শেখ মুজিবের পাক সেনানায়কদের হাতে ধরা পড়ার বিষয়টি ভারতের রাজনৈতিক পরিকল্পনার বিরাট ব্যর্থতা। তার মত জনপ্রিয় নেতা, যিনি তখন জাতির কন্ঠস্বরে পরিনত, ভারতের আয়ত্তে না থাকাতে তাদের স্বার্থে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক মীমাংসার পথে একটি অনিশ্চয়তা বিরাজ করতে থাকে। …শেখ মুজিবের অনুপস্থিতি ও পাক শাসকের হাতে তার অবস্থান ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে নিয়ে … ভারতের স্বপ্নের জন্য সেটি ছিল বিরাট অনিশ্চয়তা”। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের এরকম ‘অনিশ্চয়তা’ সরাসরি প্রভাব ফেলেছিল তাজউদ্দিন আহমেদ নেতৃত্বাধীন সরকার ও মুক্তিবাহিনীর ওপর। ভারতীয় নিয়ন্ত্রনে গঠিত হয়েছিল বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী।
তাজউদ্দিন আহমেদের সাথে ইন্দিরা গান্ধীর প্রথম সাক্ষাতকারেই অনিশ্চয়তার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। লিখেছেন মঈদুল হাসান মূলধারা ৭১ গ্রন্থে; “একাত্তরের ৩ এপ্রিল রাতে তাজউদ্দিন আহমেদকে ১ সফদর জং রোডের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। তাজউদ্দিনের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি যখন পৌছান, মিসেস গান্ধী তখন দীর্ঘ বারান্দায় হাঁটছিলেন। তাঁকে দেখতে পাওয়ার সাথে সাথে ইন্দিরার প্রশ্ন ছিল, শেখ মুজিব কোথায়? উত্তরের অপেক্ষা না করে দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, তিনি গ্রেফতার হলেন কেন? তাজউদ্দিন তাঁকে বলেন, শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, সরকার গঠন করেছেন, তারপর একটা বিভ্রাটে পড়ে তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। তাঁর এই কথায় ইন্দিরা গান্ধীর সংশয় কাটেনি’’।
এই ‘সংশয়’ ও ‘অনিশ্চয়তা’ মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রেখেছিল, আজ অবধি তার মীমাংসা হয়নি। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ দেবার জন্য ভিন্ন আলোচনা হতে পারে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে জাতিগত ঐক্য গড়ে উঠছিল তা শুরুতেই হোঁচট খেয়েছিল ভারতীয় বেসামরিক-সামরিক আমলাতন্ত্রের প্রতিযোগিতার কবলে। বলি হয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী, বিএসএফ ও ‘র’-এর পেশাগত দক্ষতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায়। গত সাড়ে চার দশকের বাংলাদেশে রক্তাক্ত বৈরীতা ও হিংসাশ্রয়ী রাজনীতির শেকড় নিহত রয়েছে এর মাঝে। মুক্তিবাহিনীর বাইরে বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী গঠন ও নিয়ন্ত্রনের মূল কারনও ছিল সেটি। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ৭নং সেক্টর কমান্ডার কাজী নুরুজ্জামান আত্মজৈবনিক গ্রন্থে বিষয়টি বর্ণনা করেছেন এভাবে:
“The Indian authorities took sole responsibility to train the certain of the crop. They (Mujib Bahini) were trained as political commandos; in some forest area near Dehra Dun… While the libaration war was going on, in India the leftist Naxalite movement was making its influence felt under the leadership of Charu Mojumder. The influence reached and strengthend a faction of the late movement in what was then East Pakistan. College student were attracted of this fraction. The Indian authorities realized that many college students with lefties ideas would joined the libaration forces and possibly help to build a leftist ideology in Bangladesh. The political commandos (Mujib Bahini) were established to neutralize such possibility’’.
গত সাড়ে চার দশকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে সকল রচনা, ইতিহাস ও আলোচনা হয়েছে তাতে আবেগ ও উচছাসের আধিক্যই লক্ষ্য করা গেছে বেশি। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে ষাটের দশক জুড়ে কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের প্রসঙ্গটি প্রায় অনুল্লেখ্য এবং বিষ্ময়কর উপেক্ষার শিকার হয়েছে। পঞ্চাশ দশক থেকে ষাটের মাঝামাঝি সময় মস্কো-পিকিং, দুই ধারার কমিউনিষ্টদের সদস্য সংখ্যা পূর্ববাংলায় বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর পূর্ববাংলায় অবিভক্ত কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য সংখ্যা নেমে এসেছিল মাত্র কয়েক’শতে। সেখানে মস্কো-পিকিং ইস্যুতে ভাঙ্গনের আগে সংখ্যাটি ছিল অনধিক তিন হাজার। ইতিহাসের এই কালপর্বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কমিউনিষ্ট উত্থান ঘটছিল। বাংলাদেশে শেষাবধি জাতীয়তাবাদী তীব্র আবেগ প্রভাব বিস্তারে বাধা হয়ে দাঁড়ালেও এর নির্ধারক ভূমিকা কমিউনিষ্টরা বিশ্লেষণ ও উপলব্দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
তরুন প্রকৌশলী ও সাবেক পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) নেতা সিরাজুল হক শিকদারের নেতৃত্বাধীন মাওবাদী কেন্দ্র এবং কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি (জাফর-মেনন-রনো) এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ব্যতিক্রম। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে উল্লেখিত নিউক্লিয়াসও এই ব্যতিক্রমেরই অংশ। নিউক্লিয়াস অন্তর্ভূক্তরা কিছুটা স্বীকৃতি পেলেও কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি ও সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বধীন মাওবাদী গবেষণা কেন্দ্রের অনুসারীদের ক্ষেত্রে সমকালীন ইতিহাস অনেকটাই বৈরী, নীরব-নিথর। যদিও রাজনীতির এই ধারাটি ভারতীয় সাহায্য ছাড়াই প্রবাসী সরকারের নিয়ন্ত্রনের বাইরে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য রণনৈতিক নৈপূন্যের স্বাক্ষর রেখেছিলেন।
ভারতের নকশালবাড়ি আন্দোলন প্রভাবিত তরুন ছাত্রনেতা সিরাজ শিকদার ১৯৬৬ সালেই গড়ে তোলেন মাও-সে-তুং চিন্তধারা গবেষণা কেন্দ্র এবং পরের বছর গঠন করেন পূর্ববাংলার শ্রমিক আন্দোলন। একাত্তরের মার্চের অনেক আগেই পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের উপনিবেশ আখ্যায়িত করে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার ডাক দেন। গেরিলা যুদ্ধে আপন শক্তিতে একাধিক মুক্তাঞ্চাল গড়ে তোলেন। একাত্তরের ৩ জুন এরকম একটি মুক্তাঞ্চল বরিশালের আটঘর-কুড়িয়ানার বিখ্যাত পেয়ারা বাগানে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন পরিবর্তিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় সিরাজ শিকদারের তাত্ত্বিক ও রণনৈতিক দিকগুলো ঢাকা পড়ে আছে নিঝুম নীরবতায়। সেই সাথে কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটিসহ অন্যান্যদের প্রতিরোধ যুদ্ধের বিষয়টিও উপেক্ষিত হয়েছে। উল্লেখ করা দরকার, নরসিংদীর বেলাবো-শিবপুর, বাগেরহাটের চিরুলিয়া-বিষ্ণুপুর, কিশোরগেঞ্জর বাজিতপুর, নোয়াখালীর হাতিয়া-লক্ষীপুর এবং যশোরের নড়াইল-শালিখা-মোহাম্মদপুর-কালিগঞ্জ ইত্যাদি স্থানে গড়ে ওঠা সশস্ত্র যুদ্ধগুলোর আলোচনা হয়েছে খুবই কম।।

No comments:

Post a Comment